Ad-1

Thursday, August 22, 2019

বাংলা গদ্যে বিদ্যাসাগরের অবদান


পুণ্যশ্লোক মহাপুরুষ বিদ্যাসাগর গত শতাব্দীর একটি প্রচন্ড বিস্ময়রুপে আমাদের মাঝে প্রতিভাত হয়েছেন। তার বিচিত্র জীবন কথা, অসাধারণ মেধা,তীক্ষ্ম বিচারবুদ্ধি এই সমস্ত আজ প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে।
শিক্ষা, বিশেষত শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে তার দান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। বিধবা বিবাহ প্রচার, বহু বিবাহ নিরোধ প্রভৃতি ব্যাপারে তিনি যে বীর্যবান পৌরুষ ও হৃদয়বান ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন গোটা বাংলাদেশে তার সমতুল্য কোন দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে না।
প্রেমের সঙ্গে বীর্য, আবেগের সঙ্গে পৌরুষ, জ্ঞানের সঙ্গে কর্ম---এর আশ্চর্য মিলন তার মধ্যে সার্থক হয়েছে।
বাংলা গদ্যের জনক নিয়ে প্রায় সুধীমহলে খর তর্কের ঝড় তুফান উঠে থাকে।
কেউ বলেন, রামমোহন বাংলা গদ্যের জনক।
কারো মতে, সে গৌরব বিদ্যাসাগরের প্রাপ্য।
কেউ বা বলেন, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপকেরা সেই গৌরব দাবি করতে পারেন, কারণ তারাই সর্বপ্রথম গদ্য গল্প কাহিনী ও ইতিহাস রচনা করেন এবং সেগুলি হচ্ছে প্রথম মুদ্রিত গদ্য সাহিত্য।

কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখলে দেখা যাবে, উনিশ শতকের বহুপূর্বে বাংলা গদ্যের জন্ম হয়েছিল, চিঠিপত্রাদিতে বাংলা গদ্যের ব্যবহার সুদূর ষোড়শ শতাব্দীতে পাওয়া যাবে। সুতরাং উল্লেখিত কেউই বাংলা গদ্যের জনকত্ব দাবি করতে পারে না, তাদের পোস্টা( প্রতিপালক) বলা যেতে পারে। তবে এরই মধ্যে আরও একটা কথা মনে রাখতে হবে। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের জনক না হলেও শিল্পসম্মত গদ্য রীতির উদ্ভাবয়িতা, তাহার মৌলিক ও অনুবাদ গ্রন্থ গুলির ভাষা দেখলেই বোঝা যাবে। 

তাকে আবার কেউ কেউ অনুবাদক বলে কিঞ্চিত কৃপা করে থাকেন। এই কথাও হাস্যকর। তার অনুবাদ গ্রন্থ মৌলিক সাহিত্যের মত এক প্রকার নতুন সৃষ্টি। এছাড়াও তার মৌলিক পুস্তিকা গুলিতে গদ্যরীতির সার্থক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। বাঙালির গদ্যসাহিত্যের দ্রুত উন্নতি ও শিক্ষা প্রচারকল্পে মৌলিক রচনাশক্তিতে সংহরণ করে তারঁ সমস্ত প্রতিভাকে অনুবাদকার্যে নিয়োগ করতে হয়েছিল। 

অলস সাহিত্যচিন্তা এই কর্মযোগী মহাপুরুষ আদৌ রুচিকর ছিল না। সম্ভবত তিনি 'art for art's sake' নীতিতে ততটা বিশ্বাসী ছিলেন না। জনকল্যাণ সাহিত্য রচনার মূল উদ্দেশ্য--- গান মতো জনহিত ব্রতীর এরকম অভিলাষ থাকাই সম্ভব।

বিদ্যাসাগর কর্তৃক অনুদিত গ্রন্থ
বিদ্যাসাগরের অধিকাংশ রচনা অনুবাদ মূলক সংস্কৃত, ইংরেজি ও হিন্দুস্থানীয থেকে স্বাধীনভাবে ভাষান্তর।১৮৪৭ থেকে ১৮৯১ সালের মধ্যে তিনি অনেক গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন।
১. 'বেতাল পঞ্চবিংশতি'(১৮৪৭) সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে নয়, হিন্দি 'বৈতাল পচ্চীসী' থেকে অনুবাদ। তখন তিনি হিন্দি ভাষা শিখেছিলেন, সেই ভাষা জ্ঞান পরীক্ষা করেছেন এই অনুবাদে।
২. 'শকুন্তলা'(১৮৫৪) কালিদাসের 'অভিজ্ঞান শকুন্তল'- নাটকের স্বচ্ছন্দ গদ্যানুবাদ।
৩. 'সীতার বনবাস'(১৮৬০) ভবভূতির 'উত্তরচরিত' এবং বাল্মিকী রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের আখ্যানের অনুসরণ।
৪. 'ভ্রান্তিবিলাস'(১৮৬৯) শেক্সপীয়রের 'Comedy of Errors' এর গদ্যে অনুবাদ -- অবশ্য শেক্সপীয়রীয় বিদেশি কাহিনীটিকে দেশীয় পরিচ্ছদ দেবার জন্য নাটকের পাত্র পাত্রীর নাম পাল্টে তিনি ভারতীয় নাম দিয়েছেন,ফলে বিদেশি কাহিনী একেবারে এদেশী রুপ ধরেছে। এগুলি হল বিশুদ্ধ সাহিত্য গ্রন্থের অনুবাদ। কাব্য বা নাটকের অনুবাদে তিনি কিন্তু গদ্য আখ্যানের রীতি গ্রহণ করেছেন। ফলে এ গুলিতে এক প্রকার নতুন স্বাদ সঞ্চারিত হয়েছে। এছাড়া তিনি কয়েকখানি পাঠ্য গ্রন্থেরও অনুবাদ করেছিলেন। যথা:
মার্শম্যানের History of Bengal এর কয়েক অধ্যায়ে অবলম্বনে' 'বাঙ্গালার ইতিহাস'( ১৯৪৮),
চেম্বার্সের 'Biographies' অবলম্বনে 'জীবনচরিত'(১৯৪৯) ও 
Rudiments of knowledge'-অবলম্বনে 'বোধোদয়'(১৮৫১) এবং ঈশপের গল্প ফেবলস অবলম্বনে 'কথামালা'(১৮৫৬) রচনা করেন। 

অনুবাদ গুলি যথার্থ মৌলিক গ্রন্থের মত মর্যাদা পেয়েছে --কোন কোনটি প্রায় ক্লাসিক সাহিত্যের পর্যায়ে উঠে গেছে। অনুবাদ ভিন্ন অতি দ্রুত গদ্যসাহিত্যের উন্নতি করা যায় না। সেই জন্য নিছক রূপচর্চার ছেড়ে দিয়ে শাশ্বত প্রতিভাকে অনুবাদ কর্মে নিয়োগ করেছিলেন।

বিদ্যাসাগরের মৌলিক পুস্তিকাঃ

বিদ্যাসাগরের মৌলিক পুস্তিকার সংখ্যাও কিছু কম নয়।
'সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃতি সাহিত্য শাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব'(১৮৫৩) বাঙালির লেখা সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস।
'বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব'(১ম খন্ড -১৮৫৫,২য় খন্ড --ঐ) এবং
'বহুবিবাহ রচিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব'(১ম --১৮৭১,২য়-১৮৭৩) শীর্ষক পুস্তিকা গুলিতে তাঁর অভ্রান্ত যুক্তি তথ্যের এবং তীক্ষ্ম বিশ্লেষণ যথার্থ প্রাবন্ধিকের প্রতিভা সুপ্রমাণিত হয়েছে। যাঁরা তাঁকে শুধু অনুবাদক বলে তার সাহিত্য- প্রচেষ্টাকে লঘু করবার চেষ্টা করেছেন, তাঁরা এই মৌলিক প্রবন্ধ পুস্তিকা গুলি পড়ে দেখেননি।
তাঁর স্বরচিত জীবনচরিত'বিদ্যাসাগরচরিত'(১৮৯১) এবং 'প্রভাবতী সম্ভাষণ'(আনুমানিক -১৮৬৩) বিশুদ্ধ সাহিত্যকর্ম হিসেবে অতীব সুখপাঠ্য হয়েছে।তাঁর আত্মজীবনীটি বাংলা জীবনী সাহিত্যের সম্পদবিশেষ।
এছাড়া 'অতি অল্প হইল'(১৮৭৩),'আবার অতি অল্প হইল'(১৮৭৩) এবং ' ব্রজবিলাস'(১৮৮৪) তিনখানি পুস্তিকা 'কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য' এই ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়।
'রত্নপরীক্ষা'(১৮৬৬) 'কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপো সহচরস্য' ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছিল। এতে প্রত্যক্ষভাবে তার নাম না থাকলেও অন্যান্য প্রমাণের বলে এগুলো তার রচনা বলেই সিদ্ধান্ত করা হয়েছে।

বাংলা গদ্যে যদি সন্নিবেশ করে, পদবন্ধে ভাগ করে এবং সুললিত শব্দ বিন্যাস করে বিদ্যাসাগর তত্ত্বের ভাষাকে রসের ভাষায় পরিণত করেছেন। বাংলা গদ্যের মধ্যেও এরকম ধ্বনিঝংকার ও সুরবিন্যাস সম্ভব, তা তারঁ আগে কেউ-ই জানতেন না।তাঁর পরিকল্পিত সাধু ভাষাই প্রার্ দেড় শতাব্দী ধরে বাঙালির লেখনীর মুখে ভাষা বের...............
জুগিয়েছে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন," বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্য ভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত,সুবিন্নস্ত,সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাকে সহজগতি এবং কার্যকূশলকা দান করিয়াছেন।"
উল্লিখিত দৃষ্টান্ত থেকেই এ কথা সহজেই বোঝা যাবে যে, বাংলা গদ্যের কায়া নির্মাণে যারা দায়ী থাকুক না কেন, এর শ্রী ও হ্রী --- বিদ্যাসাগরের দান। শতাধিক বৎসর ধরে বাঙালি জাতি তার গদ্যরীতি অবলম্বন করে আসছে। আধুনিককালে গদ্যের অনেক বৈচিত্র দেখা গেছে, কিন্তু পদান্বয় ও যতি বন্ধনে এখনো আমরা বিদ্যাসাগরকে ছাড়িয়ে নতুন কোন পদ আবিষ্কার করতে পারিনি-- যদি কেউ সেরকম দুঃসাধ্য চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেও থাকেন, তবু সে রীতি এখনও-- জনসমর্থন লাভ করতে পারেনি, জনবল্লভতা তো দূরের কথা।

No comments:

Post a Comment

Recent Post

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯

১. ‘ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ’ কবিতায় সালামের হাতে কেন অবিনাশী বর্ণমালা ঝরে ? ক. সংগ্রামী চেতনার কারণে     খ. দুঃখিনী মাতার অশ্রুজল দেখে গ. বরকত...

Most Popular Post