Ad-1

Showing posts with label ভালোলাগা সংকলন. Show all posts
Showing posts with label ভালোলাগা সংকলন. Show all posts

Sunday, October 13, 2024

"শাকেই এত লাড়া, ডাল হলে ভাঙত হাঁড়ি, ভাসত পাড়া-পাড়া।" এই কথা দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে?

এই প্রবাদটি বোঝাতে চায় যে ছোটোখাটো বিষয়ে যদি এত ঝামেলা বা উত্তেজনা হয়, তাহলে বড় কোনো বিষয়ে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। "শাকেই এত লাড়া" বলতে বোঝানো হয়েছে যে সামান্য শাক নিয়েই এত ঝগড়া বা গোলমাল হচ্ছে। এরপর বলা হয়েছে, "ডাল হলে ভাঙত হাঁড়ি, ভাসত পাড়া-পাড়া"—অর্থাৎ, যদি শাকের চেয়ে দামি বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু (যেমন ডাল) নিয়ে সমস্যা হতো, তাহলে তো পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো, এমনকি হাঁড়ি ভেঙে যাওয়ার মতো বড় ক্ষতি হতে পারত এবং তার প্রভাব আশেপাশের সবাইকে (পাড়া-পাড়া) প্রভাবিত করত।

সাধারণভাবে, প্রবাদটি ব্যবহার করা হয় যখন কেউ ছোটোখাটো বিষয়ে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায় বা অতিরিক্ত উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এটি অন্যদের সতর্ক করতে বলা হয় যে ছোট বিষয়ে এত বেশি উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয়, কারণ বড় সমস্যায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

কারো মতে এ রকম ব্যাখ্যা হতে পারে ;

শাক রান্না করতে বেশি নাড়াচাড়া করতে হয়না বা কম উল্টেপাল্টে দিতে হয়।আর ডাল রান্না করতে ডাল ঘুটনি দিয়ে ডালঘুটে দেওয়া লাগে।(শাক রান্নাতেই এত নাড়া দেওয়া লাগছে,তাহলে তো ডাল রান্না করতে গেলে বেশি নাড়া দেওয়ার জন্য হাঁড়ি ভেঙে ডাল পাড়ায় পাড়ায় ভেসে যাবে)

অর্থাৎ অল্প কারণেই যদি এত জটিলতা তৈরি হয়,তাহলে জটিল বিষয়ে মহাকান্ড ঘটবে।

Saturday, September 7, 2024

রবীন্দ্রনাথের প্রতি অপবাদ দূর

রবীন্দ্রনাথ নিষ্ঠুর জমিদার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রজাদের সারাজীবন শোষণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ কখনোই এদেশের কৃষকদের, সাধারণ মানুষের কখনো উন্নতি চাননি।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছেন, 'মূর্খের দেশে আবার কিসের বিশ্ববিদ্যালয়'।  এমন কতো অপবাদ কি অবলীলায় চালানো হয় রবীন্দ্রনাথের নামে। কতো মিথ্যাচার শুনতে হয়।

অথচ শিলাইদহ, শাহজাদপুর বাদ দিলাম এক পতিসরেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারীতে যা করেছেন বাংলার ইতিহাসে কোন জমিদার তা করেনি। 

পারিবারিক সূত্রে পাওয়া জমিদারী দেখাশোনার জন্য ১৮৯১ সালে  প্রথম পতিসরে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জমিদারি ভাগ হওয়ায় নওগাঁর কালিগ্রাম পরগণার জমিদারি পেয়েছিলেন  রবীন্দ্রনাথ।

তৎকালীন সময়ে  কালিগ্রাম পরগণা ছিল নিচু এলাকা। এক ফসলি জমি। একটিমাত্র ধানের আবাদ হয়, তাও বন্যায় ষোলো আনা পাওয়া যায় না। অধিকাংশ প্রজাই দরিদ্র।

 একবেলা খেতেও পারত না। এসব বিষয়গুলো রবীন্দ্রনাথকে ভাবিয়ে তুলতো। মহাজনী সুদ থেকে প্রজাদের বাঁচাতে রবীন্দ্রনাথ স্বজনদের কাছ থকে টাকা ধার নিয়ে ১৯০৫ সাল থেকে প্রথম ‘কৃষি ব্যাংক’ চালু করেছিলেন।

মহাজনরা অখুশি হলেও গ্রামে-গ্রামে প্রজাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই ব্যবস্থা। কৃষকদের বাঁচাতে আরো টাকা প্রয়োজন।

নিজের নোবেল পুরস্কারের ১ লাখ ৮ হাজার টাকা কৃষি ব্যাংকে দিয়েছিলেন  রবীন্দ্রনাথ। তিনি এতোটাই নিষ্ঠুর জমিদার ছিলেন ঋণ আদায় করতে না পারায় অর্থ সংকটে পড়ে ব্যাংকটি।  এমতাবস্থায় ১৯৩৭ সালে জুডিশিয়াল বোর্ড গঠন করলে ঋণ ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়।  তখন প্রজাদের কাছে থাকা ঋণের সব অর্থই আটকে যায়। 

১৯১০ সালে  পতিসরের কাছারি বাড়ির একটি কক্ষে হোমিও দাতব্য চিকিত্সালয় স্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনার। কিন্তু হোমিও ওষুধ দিয়ে সব রোগের চিকিত্সা হতো না। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অঞ্চলে প্রথম আধুনিক চিকিত্সা সেবা শুরু করেন।

 পরে সার্টিফিকেটধারী চিকিত্সক নিয়োগ দিয়ে প্রজাদের চিকিত্সা সেবা দিতেন। তখন নার্সও নিয়োগ দেয়া হয়। তিন-চারটি বেড রাখা হয়েছিল। এই চিকিত্সাসেবা ১৯২০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।

এলাকার কৃষকদের বাঁচাতে ধর্মগোলা স্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ধর্মগোলা মানে শস্যভান্ডার। যে বছর আবাদ ভালো হতো সে বছর প্রজাদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্য নিয়ে রেখে দেয়া হতো ধর্মগোলায়। 

যখন আবাদ হতো না তখন সেই গোলা থেকে কৃষকদের মধ্যে দেয়া হতো। আবার আবাদ হলে সে শস্য আবার ধর্ম গোলায় জমা করতেন কৃষকেরা। 

 সে সময় কোনো মহাজনদের কাছ থেকে এক মণ খাদ্য নিলে দেড় গুণ বা দুই গুণ খাদ্য দিতে হতো মহাজনকে। এজন্য দরিদ্র প্রজাদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল এই ধর্মগোলা।

 হতদরিদ্র প্রজাদের গাভী পালনে প্রশিক্ষণ ও ধানচাষের বাইরে অন্য পেশায় আয় বাড়াতে তাঁতব্যবস্থা, অন্য ফসলের দিকে যেন মানুষ  আকৃষ্ট হয় সে ব্যবস্থাও করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। 

এ জন্য কয়েকজনকে নিয়ে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে্য শ্রীনিকতনেও। সেখানে তাঁদের কৃষি প্রশিক্ষণ দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছেন পতিসরে। এক ফসলি জমিতে অন্য ফসল চাষ করাতে জমির আইলে খেজুর গাছ, আমগাছ, পেঁপে চাষ শুরু করান তিনি। 

এ ছাড়াও বাস্তুভিটাতে ফলের গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করতেন। এসময়ে এলাকায় অপ্রচলিত ভুট্টা, আলুর চাষ শুরু করেন। 

প্রজাদের মহাজনদের সুদের বেড়াজাল থেকে বাঁচাতে ঋণ সালিশী সংস্থা কালিগ্রাম হিতৈষীসভা গঠন করেন রবীন্দ্রনাথ

সে সময় কালিগ্রাম কাছারিবাড়ি থেকে কালিগ্রাম পরগণায় জমিদারির কার্যক্রম পরিচালনা করা হত। কালিগ্রাম পরগণার আওতায় প্রায় ৬শ’ গ্রাম ছিল। 

এই ‘হিতৈষীসভা’ তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে কালিগ্রাম হিতৈষীসভা, ভান্ডারগ্রাম হিতৈষীসভা ও পতিসর হিতৈষীসভা। কাছারি বাড়ির আওতায় থাকা প্রতিটি গ্রাম থেকে একজন গ্রাম প্রধান ও কাছারি বাড়ির একজন ও জমিদারের প্রতিনিধি একজন করে পঞ্চায়েত গঠন করা হয়েছিলো। 

এই পঞ্চায়েতের কাজ ছিলো গ্রামের সাধারণ মানুষদের বিরোধ মিটিয়ে দেয়া, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, সেতু নির্মাণ করা, পাঠশালা নির্মাণ করা। ম্যালেরিয়া হওয়ায় গ্রামের জঙ্গল কেটে ফেলা ইত্যাদি। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, সেতু নির্মাণ, পাঠশালা নির্মাণ, গ্রামের জঙ্গল কেটে ফেলতে তো টাকা লাগবে। 

কিন্তু সে টাকা কোথা থেকে আসবে? তখন সিদ্ধান্ত হলো রবীন্দ্রনাথ অর্ধেক টাকা দিবেন, আর বাকি অর্ধেক টাকা হিতৈষীসভা  দিবে।

 এভাবে কয়েক বছরের মধ্যে তখন ১১ হাজার টাকা সংগ্রহ হয়েছিল। এরপর শুরু হয় রাস্তাঘাট নির্মাণ, পাঠশালা নির্মাণ।

 ৬শ’ গ্রামের মধ্যে প্রায় ২০০ টি গ্রামে পাঠশালা নির্মাণ করে পাঠদান শুরু হয়।  এই পাঠশালার মাস্টারদের বেতন ও দিতেন রবীন্দ্রনাথ।  একইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ   তিনটি মাইনর স্কুল চালু করেন। একটি পতিসরে, অপর দুটি রাতোয়াল ও ভান্ডারগ্রামে।

 নিজের প্রজাদের জন্যে চাষ ব্যবস্থায় উন্নয়ন ঘটানো জন্যে ১৯০৬ সালে  রবীন্দ্রনাথ নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও  শিরিষ চন্দ্র মজুমদারের ছেলে সন্তোষ চন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষির উপর পড়াশুনার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। অথচ তিনি চাইলেই ইঞ্জিনিয়ারিং বা অন্য কিছু পড়াতে পারতেন! 

 রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সন্তোষ চন্দ্র মজুমদার যখন কৃষির উপর পড়তে আমেরিকা গেলেন তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁদের চিঠিতে লিখেছিলেন, 

. ‘তোমরা দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজার অন্ন গ্রাসের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ। ফিরে এসে এই হতভাগ্যদের অন্ন গ্রাস কিছু পরিমাণেও যদি বাড়িয়ে দিতে পার তাহলে মনে সান্ত্বনা পাব। মনে রেখো, জমিদারের টাকা চাষির টাকা এবং এই চাষিরাই তোমাদের শিক্ষার ব্যয়ভার নিজেরা আধপেটা খেয়ে এবং না খেয়ে বহণ করছে। এদের ঋণ সম্পূর্ণ শোধ করবার দায় তোমাদের উপর রইল। নিজেদের সংসারিক উন্নতির চেয়েও এইটেই তোমাদের প্রথম কর্তব্য হবে।’

 ১৯০৯ সালে পড়াশোনা শেষে  দেশে ফিরে এলেন রথীন্দ্রনাথ ও সন্তোষ মজুমদার।  কলকাতায় বা পশ্চিমবঙ্গে না রেখে নিজের ছেলেকে  পতিসরে নিয়ে এলে রবীন্দ্রনাথ। তখন  রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলের লাঙ্গলে চাষ করে আধুনিক পদ্ধতি শিখিয়েছেন প্রজাদের।    আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য পতিসরে ৭টি বিদেশি কলের লাঙল এনেছিলেন  কলকাতা থেকে। সঙ্গে আনিয়ে ছিলেন বিদেশি ইঞ্জিনিয়ার।

আধুনিক চাষাবাদ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়, খামার ব্যবস্থাপনা, হস্ত ও কুটিরশিল্প, তাঁতশিল্প, রেশমশিল্পের বিকাশ ঘটানো ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য রবীন্দ্রনাথ পতিসরে যা করেছিলেন তাতে পতিসর কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় দারিদ্র শূন্য হয়ে গিয়েছিলো। 

পতিসরকে মডেল হিসেবে তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,  ‘তোমরা যে পার ‍এবং যেখানে পার এক-একটি গ্রামের ভার গ্রহণ করিয়া সেখানে গিয়া আশ্রয় লও। গ্রামগুলিকে ব্যবস্থাবদ্ধ করো। শিক্ষা দাও, কৃষিশিল্প ও গ্রামের ব্যবহার‍সামগ্রী সম্বন্ধে নূতন চেষ্টা প্রবর্তিত করো।'

রথীন্দ্রনাথ ঠাকু্র তাঁর পিতৃ স্মৃতি গ্রন্থে বাবা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি তুলে এনেছিলেন।  রবীন্দ্রনাথ সেই চিঠিতে ছেলেকে লিখেছিলেন, 

'পতিসরে পৌঁছে গ্রামবাসীদের অবস্থার উন্নতি দেখে মন পুলকিত হয়ে উঠলো। পতিসরের হাইস্কুলে ছাত্র আর ধরছে না। দেখলুম– নৌকার পর নৌকা নাবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ছেলের দল স্কুলের ঘাটে। এমনকি, আট-দশ মাইল দূরের গ্রাম থেকেও ছাত্র আসছে। পড়াশুনার ব্যবস্থা প্রথম শ্রেণীর কোন ইস্কুলের চেয়ে নিকৃষ্ট নয়। পাঠশালা, মাইনর স্কুল সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। হাসপাতাল ও ডিস্পেনসারিতে কাজ ভালো চলছে। যে সব জোলা আগে এক সময় গামছা বুনতো তাঁরা এখন ধুতি, শাড়ী, বিছানার চাদর বুনতে পারছে। কুমোরদেরও কাজের উন্নতি হয়েছে। গ্রামবাসীর আর্থিক দুরবস্থা আর নেই। শুধু চাষীরা অনুযোগ জানালো তাদেরকে চাষের জন্য আরও ট্রাক্টর এনে দেওয়ার জন্য।'

রবীন্দ্রনাথ ১৯১১ সালের উইলে নিজের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি দান করেছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথকে। এক চিঠিতে

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়কে  রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,  'জমিদারি সম্পত্তির আয় নিজের ভোগে না লাগাইয়া প্রজাদের হিতার্থে যাহাতে নিযুক্ত করেন রথীকে সে সম্বন্ধে বার-বার উপদেশ দিয়াছি। তদনুসারে এইরূপ মঙ্গল অনুষ্ঠানে সে যদি তাহার পৈত্রিক সম্পত্তি প্রসন্নচিত্তে উৎসর্গ করিতে পারে তবে আমার বহুকালের একান্ত ইচ্ছা পূর্ণ হয়..'

পতিসরের জমিদারী ছেড়ে দিলেও রবীন্দ্রনাথ পতিসরকে কিংবা পরিসরের মানুষ রবীন্দ্রনাথকে কখনোই ভুলতে পারেনি। 

 তাইতো  প্রজাদের প্রবল  অনুরোধে মৃত্যুর চার বছর আগে  ১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই শেষবারের মতো পতিসরে এসেছিলেন কথিত নিষ্ঠুর ও বর্বর জমিদার রবীন্দ্রনাথ। 

ছবি-  সাধারণ মানুষের কথা শুনছেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ।




Tuesday, September 3, 2024

মাঝে নিজের অধিকার নিজেকেই প্রতিষ্ঠিত করতে হয়

বাপের বাড়ী যাচ্ছি বা বাপের বাড়ী।

এ জুতসই কথা না।

বলবেন, আমার নিজের বাড়ী যাচ্ছি। 

স্বামীর ঘর বা উনার ঘর বলবেন না।

বলবেন নিজের ঘর। 

শশুডর বাড়িটাতেও স্বামীর রুমটা নিজেরই রুম বলবেন। 

নিজেরটা নিজে না বললে, পরেরা পর করেই রাখবে। 

তাই সব আজ থেকে বলবেন।

এ অধিকার আল্লাহতায়ালা আপনাকে দিয়েছেন। 


শাশুড়ী যদি বলেন তাঁর বাড়ী, মনে মনে বলে দিবেন যদি এটা আপনার স্বামীর অধিকারে আপনার বাড়ী হয়

আমার ও নয় কি? 

মনে মনে বলবেন। 

অভিমান আর নয় 

ডাবল খাবেন আজ থেকে। জা ননাসদের ব্যবহার যদি ছাড়া ছাড়া হয় আপনিও পানখা হয়ে যাবেন। 

মনে রাখবেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার মানে টা আপনি বুঝে রক্ষা করবেন। বাবার দিকের সব আত্মীয় আপনার হকের। 

তাদের খোজ খবর নিন। 

স্বামীর দিকের গুলা জরুরী না মেইনটেইন করা, ওরা যদি রেসপেক্ট বা আন্তরিকতা দেখায় তখন ভেবে দেখবেন। ওখানে পর্দার নিয়ম বড্ড কড়া। নরম গলায় কথাও বলা যাবে না নন-মাহরাম এর সাথে। 

আপনি সস্তা না, আপনার জন্য আল্লাহ্পাক নিজে অপেক্ষা করছেন ৫ ওয়াক্ত। আপনি আসল কাজ না করে হুদাই গাল ফুলায়ে খানা না খেয়ে শরীর অসুস্থ করবেন না। 

স্বামীর সাথে ভীষন সুন্দর রিলেশন build up করুন। রিলেশন build up মানে হুদাই এর-ওর নামে গীবত করা না। রাজনৈতিক আলাপ করতে পারেন। 

যাদের জন্য অভিমান করছেন তারা কেউ ই পাশে থাকবে না। 

ঘনঘন ঘুরতে যান। ফুচকা খাবার জন্য হলেও বাসা থেকে বের হোন। পরে আর শরীর সময় কিছুই থাকবে না। 

ড. ইউনুস ও পানখা হয়ে গেছেন।

আপনি কেনো বাদ থাকবেন। যান ঘুরে আসুন বিকেলে ইচ্ছা মতো দৌড়ান হাসুন।



নীতিশ রায় এর বিখ্যাত ছবি



কিংবদন্তী ফটোগ্রাফার নীতিশ রায়ের তোলা এই ছবিটি গত কয়েকদিন থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার ঘুরপাক খাচ্ছে, কেউ বলছে ছবিটি দেশের কেউ বা বলছে বিদেশের কিন্তু মর্মস্পর্শী এই ছবিটির আসল রহস্য কি..... 

১৯৭১সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়। জামালপুর-শেরপুর অঞ্চলের আসাম-মেঘালয় গাড়ো পাহাড় সীমান্তবর্তী হাজং সম্প্রদায়ের রমণীর চিত্র।  ছবি ক্যাপশন: 'তৃষ্ণার্ত এক নারীর নদীর জল পান আর মায়ের কোলে তৃষার্ত শিশুর মাতৃদুগ্ধ পান।' জলে ভাসমান সাদা রাঙের বস্তুগুলো হচ্ছে মানুষের মৃতদেহ।

নীতিশ রায় ১৯৪৪ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের  শেরপুর শহরের নয়আনী বাজার এলাকায় প্রয়াত নন্দহরি রায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি সৌখিন আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ষাট, সত্তর ও আশির দশকে আলোকচিত্র জগতে তিনি ছিলেন একজন নক্ষত্র। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে চলে যান। ওই বছরের ১৬ জুন মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবে যোগদান করেন। সত্তর থেকে আশির দশক পর্যন্ত ইত্তেফাক, সংবাদ ও মাসিক পত্রিকা ফটোগ্রাফিসহ বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও তার ছবি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ও বিশ্বের অনেক দেশে প্রদর্শিত হয়েছে এবং পুরস্কার পেয়েছে। ১৯৮২ সনে জাপানে অনুষ্ঠিত সপ্তম এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় নীতিশ রায়ের ছবি ‘তৃষ্ণা’ ইয়াকুল্ট পুরস্কার লাভ করে।

 শিল্প-চেতনা সমৃদ্ধ আলোকচিত্রী নীতিশ রায় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, শেরপুর জেলা শাখার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন কৃষ্টি প্রবাহ ও ত্রিসপ্তক নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গেও জড়িত ছিলেন এবং অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতেন। নিঃসন্তান সাংবাদিক নীতিশ রায় এর স্ত্রী কবি সন্ধ্যা রায়। নীতিশ রায় ৭৫ বছর বয়সে ২০১৭ সালের ৮ জুন তিনি পরলোকগোমন করেন।

বিশেষ কৃতজ্ঞতা আল আমিন হোসাইন মৃধা।

Saturday, August 24, 2024

কর্মের পুরস্কার সময় মতই দেওয়া হবে......

একটি মেয়ে একটা মাংসের ফ্যাক্টরিতে কাজ করত। তার কাজ ছিল, মাংসগুলো সঠিক সাইজে কাটা।

একদিন কাজ শেষ হবার কিছু সময় আগে সে মাংস রাখার স্টোরেজ রুমে ঢুকল, যেটা মূলত কোল্ড স্টোরেজ।

হুট করে বাইরে থেকে দরজাটি লক হয়ে যায়। সে অনেক চেষ্টা করলেও দরজা খোলা সম্ভব হয় নি। অনেক চিৎকার করেও লাভ হয় নি, কারন ততক্ষণে অন্য সব কর্মীরা কাজ শেষ করে বেরিয়ে গেছে।

আস্তে আস্তে সে ঠান্ডায় জমে যেতে লাগল। মৃত্যু আসন্ন। সে কাঁদছে। কিন্তু তার বাঁচার কোন সম্ভাবনাই নেই।

হঠাৎ বেশ অপ্রত্যাশিতভাবে একজন সিকিউরিটি গার্ড এসে দরজা খুললেন এবং তাকে মুক্ত করলেন।

মেয়েটি তখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন,

আপনার তো এখানে আসার কথা নয়।

এখানে আসলেন কেন?

গার্ড উত্তর দিলেন, আমি প্রায় ৩৫ বছর ধরে এখানে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করছি।

কিন্তু আমি এমন মানুষ খুব কম দেখেছি

যারা প্রতিদিন সকালে

আমাকে Good Morning বলে ঢুকেছে এবং

সন্ধ্যায় বের হবার সময় Good Evening বলে বেরিয়েছে।

বেশিরভাগ মানুষ এমন আচরণ করত যেন তারা আমায় দেখতেই পায় নি। কিন্তু আপনি ছিলেন সেই মানুষ যে প্রতিদিন আমাকে দেখে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে Wish করতেন। আজ সকালেও করেছেন।

কিন্তু সন্ধ্যায় আমি আপনার কাছ থেকে Good Evening শব্দটি শুনতে পাইনি, তার মানে আপনি এখনো বের হন নি। আর তাই আমি আপনাকে খুঁজতে শুরু করি। আমাদের জীবন খুব ছোট। তাই সকলেই অন্যের সাথে ভালো ব্যবহার করার চেষ্টা করি।

Sunday, July 14, 2024

জীবনের সবকিছুই আপেক্ষিক

কারো মার্সিডিজ থামছে রাতের গভীরে নিষিদ্ধ পল্লীতে, ঘরে অপেক্ষারত স্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলছে...! কেউ ভাঙা ঘরে থেকে স্ত্রীকে নিয়ে অবিরত স্বপ্নের জোয়ারে ভাসছে।

কেউ ভাবছে আর কয়েকটা দিন! ডিভোর্স পেপারে সাইন করলেই মুক্তি। কেউ কেউ আবার একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য অবিরাম যুদ্ধ করে চলছে।

কেউ সদ্যোজাত সন্তানকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চাইছে। আবার কেউ একটা সন্তানের জন্য সারাটা জীবন হাহাকার করছে!

কেউ বছরে কতোজন ভালবাসার মানুষ বদলে ফেলছে!

কেউ আবার তার ভালবাসার মানুষের জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করে চলছে।

কেউ দামি শাড়ি হাতে পেয়ে তবু খুশি নয়! আবার কেউ তাঁতের নতুন শাড়ির গন্ধ বারবার শুঁকছে।

কেউ প্রিয়জন এর কাছ থেকে সোনা বা হিরের চুড়ি পেয়ে খুশি নয়, 

কেউ  প্রিয়জন এর কাছ থেকে পাওয়া কাঁচের চুড়িতে স্বর্গের সুখ খুঁজে পাচ্ছে। 

কেউ লাখ টাকার ডাইনিং টেবিলে বসেও তৃপ্তি সহকারে খেতে পারছেনা! কেউ পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা কচলিয়ে গোগ্ৰাসে পান্তা গিলছে।

কারো দামি খাটে শুয়েও ঘুমের ওষুধ খেতে হচ্ছে! কেউ আবার হিমেল হাওয়ায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

কারো পড়ার টেবিলে নতুন বইয়ের সমারোহ কিন্তু পড়ার ইচ্ছে নেই। কেউ আবার পুরাতন বইয়ের দোকান চষে বেড়াচ্ছে, পকেট খালি বলে!

কেউ বিলাসবহুল গাড়িতে বসে চিন্তিত, সন্তানগুলো মানুষ হলোনা! এতো সম্পত্তি রাখতে পারবেতো? কেউ পায়ে হেঁটে পথ চলছে, আর মনে মনে ভাবছে... সন্তানতো মানুষ করতে পেরেছি! ঈশ্বর চাইলে, ওরা নিজেরাই নিজের জীবনটা গড়ে নেবে।

নানান রঙের মানুষ,

বিভোর নানা স্বপ্নে, 

জীবন এঁকে বেড়ায়

সাদাকালো আলাপনে !!

 আসলে এটাই বাস্তবতা। সুখ এবং শান্তি সর্বদাই আপেক্ষিক।

কারো সব থেকেও "সুখ" জিনিসটাই নাই, আবার কারো বাকি সব ঘাটতি থাকলেও সুখটা আছে!

কেউ দুইবেলা খাওয়ার জন্য সারাদিন হাটে, আবার কেউ খাবার হজম করার জন্য হাটে।

জীবন যেখানে যেমন!

Tuesday, February 20, 2024

সুখী হওয়ার উপায়

আমরা ব্যক্তি,পরিবার, বন্ধু ও কর্মক্ষেত্র দ্বারা আক্রান্ত হই।তা থেকে........ 

★ মুক্তির উপায় :-----

১. শত্রুকে কাজে লাগানো।

২. সময় চূড়ান্তভাবে মেনে চলা।

৩. সঞ্চয় থাকতে হবে।

৪. কাজের মধ্যে কাজ করতে হবে।(Work in work)


★ সুখী হওয়ার উপায় :-----

১. নিজে না করে কাজ করা/কাজ না করে কাজ করা।

২. টেনশন বিক্রি। 

৩. Minimum investment maximum profit.

৪. খরচ না করে খরচ বাঁচানো।

৫. ভাগ্যের উপর বিশ্বাস। 

৬. পাপ থেকে বিরত থাকা।কথায় আছে,

     "পরিশ্রম ধন আনে,পূণ্য আনে সুখ"

৭. আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা।

৮. প্রতিকারের উপায় না থাকলে সহ্য করতে হয়।


Saturday, November 11, 2023

যেমন পাত্র তেমন শিক্ষা দেওয়া উচিত

জঙ্গলের রাজা বাঘ মশাই ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিলো - "কোনো শিশুকে নিরক্ষর রাখা চলবে না।। সবার জন্য যথাযথ শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে।।" 

সব ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে হবে।। পড়াশুনা শেষ হলে,, সবাইকে সার্টিফিকেট দেওয়া হবে।। 

শুরু হলো সর্ব শিক্ষা অভিযান!!

হাতির বাচ্চা স্কুলে এলো।‌। বাঁদর,, মাছ,, কচ্ছপ,, বিড়াল,,উট ,, জিরাফ,, সবার বাচ্চা স্কুলে পৌঁছে গেলো।। 

শুরু হলো ধুমধাম করে পড়াশোনা।‌। 

"ফার্স্ট ইউনিট টেষ্ট" হলো।। হাতির বাচ্চা ফেল।। 

- "কোন সাবজেক্টে ফেল ??" হাতি এসে প্রশ্ন করে।‌। 

-- "গাছে ওঠা" সাবজেক্টে ফেল করেছে।।" 

হাতি পড়লো মহা চিন্তায়।। তার ছেলে ফেল ?? এটা কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না।।

শুরু হলো খোঁজাখুঁজি,, ভালো টিউটর পেতেই হবে।। সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে কোনো রকম কম্প্রোমাইজ করা যাবে না।। 

হাতির এখন একটাই টেনশন,, যেভাবেই হোক,, ছেলেকে গাছে চড়া শেখাতে হবে !! "গাছে ওঠা' সাবজেক্টে টপার করে তুলতে হবে।। 

ফার্স্ট সেশন অতিক্রান্ত।। ফাইনাল রেজাল্ট আউট হলো।। দেখা গেলো - হাতি,, উট,, জিরাফ,, মাছ,, সবার বাচ্চা ফেল।। বাঁদরের বাচ্চা টপার হয়ে গেছে।। 

প্রকাশ্য মঞ্চে বিভিন্ন গেষ্টদের আমন্ত্রিত করে,, বিরাট অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলো।। সেখানে টপার হিসাবে বাঁদরের বাচ্চার গলায় মেডেল পরিয়ে দেওয়া হলো।। 

চুড়ান্ত অপমানিত হয়ে হাতি,, উট,, জিরাফ,, নিজ নিজ সন্তানকে দারুণ পিটুনি দিলো।। এতো টিউশন,, এতো খরচ,, এর পরেও চূড়ান্ত অসম্মান!! 

তারা মেনে নিতে পারলো না।। 

-- "ফাঁকিবাজ,, এতো চেষ্টা করেও তোর দ্বারা গাছে চড়া সম্ভব হলো না ?? নিকম্মা কোথাকার।। শিখে নে, বাঁদরের বাচ্চার কাছে শিক্ষা নে,, কিভাবে গাছে চড়তে হয়।।" 

ফেল কিন্তু মাছের ছেলেও হয়ে গেছে।। সে আবার প্রত্যেক সাবজেক্টে ফেল,, কেবলমাত্র "সাঁতার" কাটা ছাড়া।। 

প্রিন্সিপাল বললো -- "আপনার সন্তানের এ্যটেন্ডেন্স প্রবলেম।। পাঁচ  মিনিটের বেশী ক্লাসে থাকতে পারে না।।" 

মাছ নিজের সন্তানের দিকে ক্রোধান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইলো।। 

বাচ্চা বলে --" মা-গো,, দম নিতে পারি না,, ভীষণ কষ্ট হয়।। আমার জন্য জলের মধ্যে কোনো স্কুল দেখলে হতো না ??"

মাছ বলে -- "চুপ কর বেয়াদব।। এতো ভালো স্কুল আর কোথাও খুঁজে পাবি না।। পড়াশোনায় মন দে,, স্কুল নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।।" 

হাতি,, উট,, জিরাফ,, নিজের নিজের ফেলিওর বাচ্চাকে পিটুনি দিতে দিতে বাড়ি ফিরে চলেছে।। পথিমধ্যে বুড়ো খেঁকশিয়ালের সঙ্গে দেখা।। 

শিয়াল বলে -- "কি হয়েছে সেটা তো বলো ??" 

হাতি বলে -- "এত বড়ো শরীর নিয়ে,, গাছে চড়তে পারলো না।। বাঁদরের ছেলে টপার হলো,, মান ইজ্জত কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না।।" 

শিয়াল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।।

শিয়াল বলো -- "তোমাদের গাছে চড়ার কি প্রয়োজন সেটাই তো বুঝতে পারলাম না‌।। শোনো হাতি,, তুমি নিজের বিশালাকার শুঁড় উঠিয়ে ধরো,, গাছের সবচেয়ে বড়ো ফলটি পেড়ে ভক্ষণ করো।। তোমার গাছে ওঠা লাগবে না।।"

-- "উট ভাই,, তোমার অনেক উঁচু ঘাড় রয়েছে।। ঘাড় বাড়িয়ে দাও,, গাছের সর্বশ্রেষ্ঠ ফল,, পাতা পেড়ে খাও।।" 

-- "বোন মাছ,, তোমার সন্তানকে নদীর স্কুলে ভর্তি করে দাও।। ওকে মনভরে সাঁতার কাটতে শেখাও।। দেখবে,, একদিন তোমার ছেলে নদী অতিক্রম করে সমুদ্রে পাড়ি দেবে।। সাত সমুদ্র পার করে,, তোমার নাম উজ্জ্বল করে দেবো।। ওকে রাজার স্কুলে মোটেও পাঠিও না।। ও মারা যাবে।।" 

মনে রাখতে হবে,, *শিক্ষা আপনার সন্তানের জন্য,, শিক্ষার জন্য আপনার সন্তান নয়*

 প্রত্যেক শিশুর মধ্যেই কিছু না কিছু স্পেশালিটি আছে।

আমাদের দায়িত্ব হলো, সেটা খুঁজে বের করা। তাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দেওয়া। তাহলেই দেখবেন,, সে নিজেই নিজের গন্তব্য খুঁজে নেবে।

[সংগৃহীত]


Thursday, July 20, 2023

ভার্সিটির এক বড় ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,তুমি কি আহমদ ছফা পড় নাই?

আমি বলেছিলাম,না।

উত্তরে তিনি বলেছিলেন,তাহলে কী পড়লে এতদিন ধরে?

আমি সেদিন লজ্জিত হয়েছিলাম।

আরেকদিন ফেসবুকে পেলাম,কেউ লিখেছে হয়ত মনে নাই ততটা,

" যিনি আহমদ ছফাকে পড়েন নাই,তিনি বাংলা এবং বাংলাদেশকেই চিনেন নাই"

তো প্রথমেই পড়া শুরু করলাম "যদ্যপি আমার গুরু" ব‌ইটা দিয়েই। সত্যি বলতে,ব‌ইয়ের প্রথম থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত যেন জ্ঞানমূলক তথ্যে ঠাসা। সবকিছু যেন আমাকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে।এতসব যেন মাথায় ই ধরছে না আমার।

অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়তে থাকলাম আর অভিভূত হতে থাকলাম। রঙিন কলম দিয়ে আঁকানোর অভ্যেস আছে আমার, কিন্তু,সব পৃষ্ঠাতেই যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লেখা আমি কলম‌ই লাগাতে পারছি না মনে হচ্ছে।

জাতীয় অধ্যাপক স্যার আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে  আহমদ ছফা দেশ-বিদেশের অনেক বিশিষ্ট,বিখ্যাত ব্যক্তিদের আলোচনা‌ও করেছেন।

এসব কিছুই যেন আমার কাছে মনে হচ্ছে, নতুন জগতে প্রবেশ করলাম - যেন এটা একটা বিশ্বকোষ।

স্যার আবদুর রাজ্জাক সাহেবের পুরান ঢাকার ভাষা বেশি আকৃষ্ট করেছে এবং তাঁর বিষয়ে বেশি কিছু বলার দক্ষতা আমার নেই।

এক কথায় সাধারণভাবে জীবনযাপন করা অসাধারণ একজন মনীষী। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই।

স্যার আবদুর রাজ্জাকের ভাষ্যমতে,,,

১. যখন কোনো নতুন জায়গায় যাইবেন,২ডা বিষয় খেয়াল রাখবেন।ওই জায়গার মানুষ কি খায় আর পড়ালেখা কি করে। কি খায়, কি পড়ে এই ২ডা জিনিস না জানলে একটা জাতির কোনো কিছু জানন যায় না।

২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩টি প্রধান অবদান হলো- পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন আর বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম। কিন্তু, জ্ঞানচর্চার যে আর‌ও একটা বৈশ্বিক মানদন্ড রয়েছে,তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বিশেষ কিছু নেই।

৩. বড় লেখক এবং বড় মানুষ এক নয়। বড় লেখকদের মধ্যে বড় মানুষের ছায়া থাকে।বড় মানুষরা আসলেই বড় মানুষ।

৪. বাংলা ভাষাটা বাঁচাইয়া রাখছে চাষাভুষা, মুটেমজুর -এরা কথা কয় দেইখ্যাই ত কবি কবিতা লিখতে পারে।

৫. ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান অইবার একটা সুযোগ দিছিল। তিনি এইডা কামে লাগাইবার পারলেন না।

৬. মাওলানা আব্দুল কালাম আজাদের সত্য কথা বলার অভ্যাস আছিল খুব কম,অ্যান্ড হি ওয়াজ এ কনজেনিটাল লায়ার।

৭. আইজকার ইন্ডিয়ার এডুকেটেড মানুষেরা যে ভাষায় পরস্পরের লগে কম্যুনিকেট করেন,হেইডা কোনো ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ না। ব্রিটিশদের চ‌ইল্যা যাইবার পঞ্চাশ বছর পরেও যারা একটা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা তৈয়ার করতে পারে নাই,তারা একলগে থাকব কি ক‌ইর‌্যা আমি তো চিন্তা করবার পারি না।

৮. যার মনে দয়া নাই,তারে উপরে আনা ঠিক নয়।

৯. আর্যরা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করলে বেদে উল্লেখ থাকত।বেদে এক্কেরে জন্মান্তরবাদের ছিটেফোঁটাও নেই।এইডা তারা পরে ড্রেভিডিয়ানদের কাছ থেইক্যা ইনহেরিট করছে।

১০. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পড়াশোনা অইছিল মুসলমানের টাকায়। মুহসিন ফান্ডের টাকায় তিনি লেখাপড়া করছিলেন। মুসলমানদের বিরুদ্ধে কলম ধ‌ইর‌্যা সেই ঋণ শোধ করছিলেন।

১১. যে জাতি যত সিভিলাইজড তার রান্নাবান্নাও তত বেশি সফিস্টিকেটেড।পশ্চিমারা সভ্য অইছে কয়দিন।এই সেদিন‌ও তারা মাছ মাংস কাঁচা খাইত।

১২. আধুনিক বাংলা ভাষাটা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পন্ডিতেরা অভিধান দেইখ্যা দেইখ্যা বানাইছে।

১৩. আধুনিক বাংলা - বঙ্গসন্তানের ঠিক মুখের ভাষা না, লেখাপড়া শিইখ্যা লায়েক অইলে তখন ওই ভাষাটা তার মুখে আসে।

১৪. ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের একটা বড় পার্থক্য এইখানে যে, ইসলাম ধর্মে পরকালের গুরুত্ব স্বীকার করা অইছে, কিন্তু ইহকালের গুরুত্ব‌ও অস্বীকার করা অয় নাই।

১৫. সুরুচিসম্পন্ন সংস্কৃতিবান অধিক মানুষ আমাদের সমাজে সত্যি সত্যি বিরল। এখানে একজন বড় কাজ করলে উৎসাহ দেওয়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসে না।


এরকম স্পষ্টভাষী পন্ডিতের সহচর্য পাবার আকাঙ্ক্ষা সবসময়ই রয়ে যায়। আজ থেকে যেন আহমদ ছফা পড়া চলতেই থাকবে..........,


Sunday, November 1, 2020

গদ্য, পদ্য ও কবিতা ময়ুখ চৌধুরী

[কবি ময়ুখ চৌধুরী আশির দশক থেকে সাহিত্যকর্মে নিজস্ব কাব্যস্বরের জন্য সুপরিচিত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ১০টি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে চার দশক অধ্যাপনার পর বর্তমানে অবসরে আছেন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে চবি শিক্ষক লাউঞ্জে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক জনাব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ও জনাব নাজেমুল আলম মুরাদ-এর সাথে তিনি গদ্য, পদ্য ও কবিতা নিয়ে খোলামেলা কিছু কথাবার্তা বলেন। এটি সেই আলাপচারিতার পরিমার্জিত অনুলিখন।]

***
ময়ূখ চৌধুরী: আমি যেটা বলছি, এটা নিছক কোনো বই পড়া বিদ্যা নয়। দীর্ঘদিনের অধ্যয়ন, অনুশীলন, তৎপরতা— এগুলোর মাধ্যমে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সে অভিজ্ঞতার আলোকে কথা বলছি। আমি যে কথা বলবো সেগুলো কোনোদিন লিখিত হবে, সেগুলো পড়ে কেউ জানবে। আবার কেউ লিখে গিয়েছিল, সেটা পড়ে আমি জেনেছি।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্যার, আমরা জানতে চেয়েছিলাম, পদ্য এবং কবিতার মধ্যে পার্থক্য কী?
ময়ূখ চৌধুরী: পদ্যের মধ্যে একটা য-ফলা দেখছেন না? এই য-ফলাটা একটা প্রত্যয়। প্রকৃতি-প্রত্যয়। প্রকৃতি মানে হচ্ছে গাছ। প্রত্যয় হচ্ছে করাত। সাধিত শব্দ হচ্ছে জানালা। গাছ আর কাঠ এক জিনিস নয়। গাছ থেকে যে কাঠ হলো, নিশ্চয় কোনো একটা প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে তার সঙ্গে। এ প্রত্যয় কোনো একটা ইন্সট্রুমেন্ট হতে পারে। করাত হতে পারে, হাতুড়ি হতে পারে। কাঠটা যে টেবিল হলো, রূপান্তরিত হলো, প্রতিটি রূপান্তরের পিছনে কিছু না কিছু যুক্ত হচ্ছে। যেমন, শ্রম। এই শ্রম উপকরণ যোগে অথবা উপকরণ ছাড়া, উপাদান যোগে বা উপাদান ছাড়া যুক্ত হচ্ছে। গাছ ® কাঠ ® টেবিল।
একটা গাছ কখনো নিজে নিজে টেবিল হতে পারে না। তার সঙ্গে মানবগুণের প্রত্যয় যুক্ত হয়ে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় তখন সেটি অর্থনীতির ভাষায় ‌‘পণ্য’ হয়। তাহলে পদ্যের মধ্যে য-ফলা যুক্ত হয়ে যে পদ্য হলো, রূপায়ন হলো, সেখান থেকে য-ফলাটা তুলে নিলে থাকে পদ। পদ মানে হচ্ছে পা। এই আলোচনায় ব্যাকরণের পদ পরে আসবে। কারণ, ব্যাকরণ সৃষ্টি হয়েছে ভাষা সৃষ্টির বহুকাল বাদে। আইন সৃষ্টি হয়েছে বহু পরে। আগে মানব সমাজ তৈরি হয়েছে। সমাজের নর্মস, টেস্ট, টেম্পারমেন্ট, অ্যাটিচিউড সবকিছু মিলিত হয়ে যখন একটা মৌখিক সংবিধান তৈরি হয়, সেটা হচ্ছে কালচার। কালচারটাকে আরো সঙ্গতি দিয়ে আইন তৈরি করা হয়।
তাহলে যেদিন আমাদের সমাজে একটা শব্দ তৈরি হলো ‘পদ’, তখন পদ মানে ছিল পা। মানুষ প্রথমে যা দেখে তার নামকরণ করে। এটা সবুজ, সবুজ থেকে সবজি হয়েছে। এটা কী রং? হলুদ রং। নিশ্চয় হলুদের মতো রং। তাহলে হলুদ তো আগে প্রকৃতিতে থাকতে হবে। কোনো কিছু কমলা রং হওয়ার জন্য কমলা আগে প্রকৃতিতে থাকতে হবে। তারপর আমরা কমলা রং বলবো। কোনো কিছু খয়েরী রং হওয়ার জন্য আগে পানের সঙ্গে যে খয়ের মিশায়, ওটা থাকতে হবে। তারপর বলবো যে খয়েরী রং। এই যে শব্দগুলো তৈরি হচ্ছে সেটি আগে বস্তুগতভাবে জন্ম নিচ্ছে। তারপর তার নামকরণ করা হচ্ছে। যেমন আমার একটি কবিতা আছে—
হরিণকে যে হরিণ বলি
হরিণ কি তা জানে?
পদ্মা নদী ভেসে গেলো
চর্যাপদের টানে।
হরিণ জানে না যে আমরা তাকে হরিণ নামে নামকরণ করেছি।
প্রশ্ন: প্রাণীটা কী রকম?
উত্তর: হরিণের মতো সুন্দর।
তারমানে হরিণ নয়, হরিণের মতো।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্যার, পদের কথা বলছিলেন।
ময়ূখ চৌধুরী: প্রথমত, পদ মানে পা। তাহলে এই পদের কাজ কী? এর মাধ্যমে আমি দাঁড়াতে পারি, হাঁটতে পারি। এইবার ব্যাকরণবিদরা ব্যাকরণের কোনো একটা অধ্যায়ের নাম দিচ্ছেন ‘পদ’। নিশ্চয় তারা জানেন যে এর আগে পদ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে পা অর্থে। তাহলে বাক্যের অন্তর্গত বিভক্তিযুক্ত প্রত্যেকটি শব্দকে যে পদ বলছে, কেন বলছে? পরে দেখলাম, শব্দ বিভক্তিযুক্ত হয়ে হাঁটতে আরম্ভ করে। হাঁটা শেষ হয় দাঁড়িতে গিয়ে। তখন সে একটা ভাব প্রকাশ করে। এই পদনির্ভর অন্ত্যমিল যুক্ত যে ম্যাসেজ বা ভাবনা, সেটাই পদ্য। কিন্তু পদ্যের একটা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে পদ্য প্রতিটি শব্দকে ব্যবহার করে অভিধানে নির্দেশিত অর্থ অনুযায়ী। অথবা অভিধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ অর্থ অনুযায়ী। সেটা পদ্য।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: পদ্যের মধ্যে অন্ত্যমিল থাকলেও সেটা কবিতা হবে না। যদি সেটাতে কোনো দূরবর্তী অর্থবোধকতা না থাকে।
ময়ূখ চৌধুরী: হ্যাঁ। অন্ত্যমিল থাকলেও সেটা কবিতা হবে না। এবার একটা পদ্যের উদাহরণ দিই। তত্ত্ব না বলে আগে উদাহরণ দেয়া ভালো। তারপর বিশ্লেষণ করা ভালো। বাল্যশিক্ষার মধ্যে একটা পদ্য আছে, যেটাকে আমরা দীর্ঘদিন কবিতা বলে জেনেছি, পড়েছি, শ্রদ্ধা করেছি:
“পাখি সব করে রব রাতি পোহাইলো
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল।”
এটি লিখেছেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। তিনি বুদ্ধিমান। ভালো কাজ করেছেন। তথাকথিত কবিতাটা বা পদ্যটার নাম দিয়েছেন ‘প্রভাত বর্ণনা’। Just a description or statement. Not creation. এবার “পাখি সব করে রব রাতি পোহাইলো”— এই পাখির নিচে আন্ডারলাইন করি। এটার ইংরেজি মিনিংটা কী? বার্ড। পাখিসব আওয়াজ করছে সকালবেলা, রাত শেষ হয়ে গেছে। আর কাননে কুসুমগুলো প্রস্ফূটিত হয়েছে। এটি হলো পদ্যের সুস্পষ্ট উদাহরণ।
এবার আরেকটা রচনায় আমরা ‘পাখি’ শব্দটার ব্যবহার দেখি:
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মনবেড়ি
দিতাম পাখির পায়।”
এবার এখানে পাখির নিচে যে আন্ডারলাইন করলেন, এটার ইংরেজি মিনিং কী?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এখানে তো স্যার সিমিলিটা চলে আসছে। এটা ডিস্ট্যান্ট মিনিংয়ে চলে গেছে। গ্রামাটিক্যাল মিনিং আর নাই।
ময়ূখ চৌধুরী: দিস ইজ কারেক্ট। আমরা বুঝতে পারছি, এখানে পাখি বলতে আত্মার কথা বুঝানো হচ্ছে। দেহ-খাঁচার ভেতর ঢুকছে আর বেরুচ্ছে কীভাবে? আই ডোন্ট নো। কেমনে আসে যায়। এটা একটা বিরাট বিস্ময়।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এখানে স্যার পাখিটা অচিনের সাথে মিলে অর্থটা তৈরি করেছে।
ময়ূখ চৌধুরী: অচিন পাখি। মানে আত্মা, soul। পৃথিবীর কোনো ডিকশনারিতে কি আছে, পাখি মানে soul? তাহলে লালন ফকির ‘অশিক্ষিত’ হয়েও, অর্থাৎ আমাদের ভাষায় ইউনিভার্সিটির ছাত্র না হয়েও পাখিটাকে নিজের অর্থে ব্যবহার করেছেন। সেখান থেকে আরেকটা মিনিং বের করে দিয়েছেন। কীভাবে? ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। তার কবিতার লাইনে এমনভাবে তিনি শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন, তখন সেটি ডিকশনারির অর্থ থেকে কই মাছের মতো লাফ দিয়ে বাইরে চলে গেছে, এস্কেপ করেছে। এই যে অভিধানে নির্দেশিত অর্থ থেকে মুক্ত হয়ে ভিন্ন অর্থে যখন এক বা একাধিক কিংবা ততোধিক শব্দ প্রকাশ করবে, তখন সেটা কবিতার শব্দ হবে। এ রকম শব্দ যদি না থাকে তাহলে সেটা কবিতা হবে না
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তাহলে স্যার অন্ত্যমিলের ব্যাপারটা?
ময়ূখ চৌধুরী: অন্ত্যমিলের কোনো প্রয়োজন নাই। নামতার মধ্যেও তো অন্ত্যমিল আছে।
এক একে এক
দুই দুগুণে চার
চার দুগুণে আট
দশ দুগুণে বিশ।
এখানে ছন্দ মিলছে তো! (কিন্তু সেটি তো কবিতা হয়ে উঠছে না।)
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্যার, আপনি কবিতার ব্যাপারে যেটা বললেন, এই ধরনের অর্থবোধক, ডিস্ট্যান্ট মিনিং…
ময়ূখ চৌধুরী: ডিস্ট্যান্ট মিনিং না। অভিধানের শাসনমুক্ত।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: রূপক?
ময়ূখ চৌধুরী: রূপকও না। রূপক নিয়ে পরে আলোচনা করবো। অভিধান শাসিত অর্থ থেকে মুক্ত হয়ে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করা। ডিফারেন্ট মিনিং। ডিসট্যান্ট বলবেন না, ডিফারেন্ট।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ডিফারেন্ট। আচ্ছা, ঠিক আছে। ডিফারেন্ট এবং ডিসট্যান্ট এক নয় স্যার। ঠিক আছে। ডিফারেন্ট মিনিং নিয়ে আসলে তখন সেটা…
ময়ূখ চৌধুরী: (তখন সেটা) কবিতার শব্দ হবে। আর এরকম শব্দ সংবলিত যেকোনো রচনা— ছন্দ থাক বা না থাক, অন্ত্যমিল থাক বা না থাক— ওটা কবিতা হবে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আরেকটা জিনিস আমরা দেখি যে কবিতার বাক্যগুলো ডায়লগের মতো ভাঙা ভাঙা হয়।
ময়ূখ চৌধুরী: হ্যাঁ, হতে পারে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: যদি কেউ ডায়ালগের মতো না ভাঙলো, কিন্তু লেখার মধ্যে একটা রিদম আছে এবং…
ময়ূখ চৌধুরী: না, টানা গদ্য। ক্লোজড ভার্স। আমি গদ্যের মাধ্যমে বললাম।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: গদ্যের মাধ্যমে কি কবিতা হয়, স্যার?
ময়ূখ চৌধুরী: হয়। ২০০ বছর আগে ফ্রান্সে হয়ে গেছে। ফ্রি ভার্স।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ফ্রি ভার্স?
ময়ূখ চৌধুরী: আমার যে বইটি বেরুলো ‘চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডুহীন’ (এটি গদ্যকবিতার বই)।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আচ্ছা স্যার, আমাদের পাঠ্যবইয়ের মধ্যে যে ভাগ করা হতো— প্রোজ অ্যান্ড পয়েট্রি…
ময়ূখ চৌধুরী: ওটা মোটাদাগে বলা হতো। প্রোজ মানে কী? ফিকশন? শর্ট স্টোরি? নভেল? অ্যাসে?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: না।
ময়ূখ চৌধুরী: তাহলে? মোটাদাগে বলা হয়েছে প্রোজ। মোটাদাগে বলা হয়েছে পয়েট্রি।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তাহলে পয়েট্রির মধ্যে পদ্য ইনক্লুডেড?
ময়ূখ চৌধুরী: ইনক্লুডেড। ওটা(ভাগাভাগি) সিলেবাসওয়ালারা করেছেন। সিলেবাস তো আমাদের কাছে মাননীয় না৷ কারণ, পৃথিবীর প্রথম কাব্য যারা লিখেছেন তাদের কোনো সিলেবাস ছিলো না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এটা নিয়ে ঐদিন রাতে কথা বলেছিলেন। মহাকাব্য কীভাবে লেখা হয়েছে সে অনুসারে এখন আমরা মহাকাব্যের হদিস বের করছি কীভাবে কী হয়েছে। কিন্তু প্রথম মহাকাব্য যিনি লিখেছেন…
ময়ূখ চৌধুরী: তিনি তো জানতেন না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল রিসার্চ মেথডলজি। আমরা কাজ করি হিউম্যান রিলেশন নিয়ে, কনসেপ্ট নিয়ে। আমাদের (রিসার্চে) তো কোনো এম্পেরিক্যাল ডাটা নাই।
ময়ূখ চৌধুরী: ফিলসফির চিন্তা মাত্র দুইটা জিনিস নিয়ে। এক হচ্ছে জীবন কী, দুই হচ্ছে জগৎ কী। খুব ছোট সিলেবাস। কেউ বলতে পারেন, এগুলোকে ‘ছোট’ বলছেন কেন? (আমার উত্তর হলো) কিন্তু এরমধ্যে তো সবই আছে। ফিলসফির বাইরে কী আছে?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনি তখন বলেছিলেন, রিসার্চ মেথডলিজর কথা যারা বলছেন, সেই রিসার্চ মেথডলজি তৈরি হওয়ার আগে রিসার্চ কীভাবে হয়েছে? আর রিসার্চ মেথডলজি একটা হওয়ার পরে কেন পরবর্তীতে আরো কয়েকটা হয়েছে?
ময়ূখ চৌধুরী: পৃথিবীতে যিনি প্রথম পিএইচডি করেছেন তিনি কি কোনো পিএইচডি হোল্ডারের আন্ডারে পিএইচডি করেছেন?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনি তখন বলেছিলেন, কিছু হচ্ছে মৌলিক রচনা। সেগুলোতে উদ্ধৃতি দেয়া, মেথডলজি ফলো করা ইত্যাদি থাকে না, দরকার হয় না। তার মানে কি স্যার আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মই করি দিয়েছি ‘‌‌‌তোমাকে মিডিওকার হতে হবে? তুমি প্রাইমারি হতে পারবে না! হলে তুমি ডিগ্রি পাবে না! তোমার লেখায় যদি উদ্ধৃতি না থাকে, কোনো ফরম্যাট না থাকে তাহলে তোমার লেখাটা লেখাই হয় নাই!’ অথচ মৌলিক লেখা, কথার কথা রবীন্দ্রনাথের লেখায়, কী মেথডলজি ফলো করা হয়েছে? আমরাই বের করছি মেথডলজি কী…।
ময়ূখ চৌধুরী: আমরাই রবীন্দ্রনাথের লেখাকে উদ্ধৃতিতে নিয়ে আসছি। রবীন্দ্রনাথ তো কোনো উদ্ধৃতি চিহ্ন দেননি। এমন আরেকজন হচ্ছেন হুমায়ুন কবির। পশ্চিম বাংলার। তিনি ‘বাংলার কাব্য’ নামে ছোট একটা বই লিখেছেন। কোনো উদ্ধৃতি চিহ্ন নেই। সব তাঁর নিজের কথা।
নাজেমুল আলম মুরাদ: হুমায়ুন কবির বলতে ‘নদী ও নারী’ যিনি…
ময়ূখ চৌধুরী: ‘নদী ও নারী’ লিখেছেন। তো, কবিতা হচ্ছে মানুষের অনুভূতির একেবারে মোস্ট পারফেক্ট অংশটাকে শব্দে রূপ দেওয়া। সুরে রূপ দিলে মিউজিক হবে, শব্দে রূপ দিলে কবিতা হবে, রঙে রূপ দিলে পেইন্টিং হবে। সবগুলোই একই জিনিস। মানুষের যে উপলব্ধি, অনুভূতি, পর্যবেক্ষণ, কল্পনা এবং সর্বশেষ ইনটুইশান(স্বজ্ঞা)…। ইনটুইশান হচ্ছে ‘ফানাফিল্লাহ’। এরপরে আর নাই। এইসবগুলোকে একেবারে জমাট করে মিনিমাম কথার মধ্যে বেশি কথা বলতে পারে কবিতা। আর এটাকে ইলাবোরেট করলে তা ফিলসফি হয়ে ওঠে।
নাজেমুল আলম মুরাদ: তাহলে স্যার আপনার কবিতা হচ্ছে দর্শনের কাব্যিক রূপ?
ময়ূখ চৌধুরী: দর্শন তো সবাই করে। এটা তো দার্শনিকরাই বলেন, সবাই কমবেশি নিজে নিজে দার্শনিক। যেমন, আমি বলি। আমার গায়ে এখন উত্তাপ আছে। মাপলে কত দাঁড়াবে? নাইনটি এইট পয়েন্ট এক্স, আমি পরিষ্কার জানি না কত। এর সঙ্গে মাত্র ১ ডিগ্রি যোগ করলাম। ডাক্তার এসে বলবে জ্বর কত? তখন আমার ঘরের লোকজন বলবে ৯৯ ডিগ্রি। ৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট জ্বর! আচ্ছা ৯৯ ডিগ্রি জ্বর হলে ঐ জ্বর থেকে ১ ডিগ্রি মাইনাস করো। ৯৮ ডিগ্রি। তখন কী হবে? বলবে যে উত্তাপ। এতক্ষণ বলছে উত্তাপ, ১ ডিগ্রি যোগ করলে বলছে জ্বর। তার মানে, আমরা সবাই ফিলসফার ৯৮ পর্যন্ত।
নাজেমুল আলম মুরাদ: (মোজাম্মেল) স্যারের কথা একটা মনে পড়ছে…
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: Everyone does philosophy, but only a few are aware of doing this!
নাজেমুল আলম মুরাদ: স্যার আপনি ক্লাসে একবার বলেছিলেন, কতটুকু হলে আমি ঠাণ্ডা বলবো, কতটুকু হলে আমি গরম বলবো, তা আমার মনে আছে স্যার। আপনি এসির তাপমাত্রা নিয়ে কথা বলেছিলেন।
ময়ূখ চৌধুরী: তাপমাত্রার একটা প্যারামিটার তৈরি করে দিয়েছে সায়েন্স। ৯৮ ডিগ্রি বা এত পর্যন্ত উত্তাপ, ১ ডিগ্রি যোগ করলে আমরা বলছি জ্বর।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আমার শিক্ষকতা জীবনের যেসব প্রাপ্তি তার মধ্যে অন্যতম একটা হচ্ছে আমি ময়ূখ চৌধুরীর একজন প্রিয়-মানুষ হতে পেরেছি এবং কাছাকাছি হতে পেরেছি। স্যারের মত হতে চাই। এবং এরকম মানুষ ছিল প্রফেসর ওয়াহেদুর রহমান স্যার। আমাদের ওয়াহেদুর রহমান স্যার এরকম জাত শিক্ষক ছিলেন। উনি যখন ক্লাস নিতেন তখন উনি সবকিছু হারিয়ে ফেলতেন। উনি আমাদেরকে বলতেন, “শুনো, আমি দুইটা সময়ে জীবনের দুঃখ সব ভুলে যাই। যখন আমি নামাজ পড়ি এবং যখন আমি ক্লাস নিই।” মিডিওকার স্টুডেন্টরা উনাকে বুঝতে পারতো না।
ময়ূখ চৌধুরী: যা হোক, কবিতার ব্যাপার হচ্ছে, সমকালে প্রচুর কবিতা লেখা হবে। কিন্তু ১০ থেকে ২০ বছর পরে অনেকে লেখা বন্ধ করে দিবেন। আজকের দুর্বল কবিতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত কবিদের ভালো কবিতার তুলনা করে আমরা বলি, ‌’এগুলো কি কবিতা নাকি?’
আমিও তো বলছি এগুলো কবিতা না। রবীন্দ্রনাথের সময়ে কেউ কবিতা লেখেনি? সেগুলো কই? সবকালে কিছু কবিতা লেখা হবে পাতার মত। কিন্তু ফুল ফুটবে কম। একটা গাছের সবগুলো ফুল হয় না। পাতা হয় বেশি। ঐ পাতাগুলোর দরকার আছে ফুলকে ঝড়ঝাপটা, অতিবৃষ্টি, অতিরোদ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। ফুল কম ফুটবে, ফল আরো কম হবে। রবীন্দ্রনাথের আমলে যারা লিখেছেন, নজরুলের আমলে যারা লিখেছেন তারা কোথায়? কেউ নাই। ইতিহাস হচ্ছে নির্মম ঝাড়ুদার। সে ঝাড়ু দিয়ে সব পরিস্কার করে দিবে। কিছু রেখে দিবে।
নাজেমুল আলম মুরাদ: ঝাড়ু দেয়ার জন্য পাতা তো লাগবেই।
ময়ূখ চৌধুরী: লাগবে। আজকের দুর্বল কবিতাগুলো সামনে রেখে ‌‘হোয়াট ইজ পোয়েট্রি’ বিচার করবেন না। আজকে যারা ভালো লিখছে, জিজ্ঞেস করেন, আপনি যদি না জানেন এক্সপার্ট একজনকে জিজ্ঞেস করেন, কারগুলো পড়বো, কারগুলো পড়বো না। তখন দেখবেন যে আপনার সিলেবাস ছোট হয়ে আসছে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্যার আপনার কথাটা যদি একটু রিপিট করেন যে, আজকেরগুলোর প্রেক্ষাপটে আমরা অতীতেরগুলোকে…। এখন থেকে ১০-২০ বছর পরে এখনকার লোকেদের লেখা কতটুকু টিকবে সেটা অনুসারে বুঝা যাবে এটা আসলে কবিতা হয়ে উঠছে কিনা। তাই তো?
ময়ূখ চৌধুরী: হ্যাঁ। যেমন ’৩০ এর কবিতার মধ্যে জীবনানন্দ দাশ টিকে রয়েছেন। ৮ দশক আগের এক ‌‘বনলতা সেন’ মাস্টারপিস দিয়ে। সুধীন দত্ত টিকে আছেন ‌‘উটপাখি’র জন্য। বুদ্ধদেব বসু কবি হিসেবে না, অন্য হিসেবে টিকে আছেন। ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক হিসেবে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্যার আপনি যেটা বললেন, এটা কি একজন কবির জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে যে, তিনি অনেক লিখবেন, কিন্তু তাঁর সবলেখা…?
ময়ূখ চৌধুরী: হ্যাঁ, অনেক লিখবেন, সবলেখা ততটা মানসম্পন্ন হবে না। আমি তো বলছি, আমি পাতার মত অনেক লিখি, পাতার মত অনেক ছাপি। কিন্তু বই করার সময় আমি ফুলগুলো বেছে বেছে ‌‘দেবতাকে পূজা দিই’, ওখানে পাতা দেই না। এটাই নিয়ম। আপনি কোনো একটা ভালো অনুষ্ঠানে গেলে চুজি হয়ে থাকেন আপনার পোষাকের ব্যাপারে। স্যুট-টাই কমপ্লিট পরে তারপর আপনি যান।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্যার আরেকটা হলো, যারা লিখেন, আপনিসহ, আমরা বিশেষ করে নজরুলের অনেক পাণ্ডুলিপি দেখি, বা অনেকেরই, সেখানের মধ্যে অনেক কাটাকাটি দেখি।
ময়ূখ চৌধুরী: রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ সবাই কাটাকাটি করেছেন। সবচেয়ে বেশি কাটাকাটি করেছেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনি একটা কথা একবার আমাকে বলেছিলেন। আমি এক্সাক্টলি স্মরণ করতে পারছি না। ভুল হলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং সংশোধন করে দিবেন। আপনি বলেছিলেন, ‌‘আমার পাণ্ডুলিপি আমি কাউকে দেখাই না, কারণ আমার কাটাগুলো যাতে লোকেরা না দেখে এবং আমাকে আন্ডারমাইন যাতে না করে।’
ময়ূখ চৌধুরী: আমার অপ্রকাশিত লেখাগুলো, যেগুলো ছাপাইনি, সেগুলো আমি পুড়িয়ে ফেলবো। আমার দুর্বলতার চিহ্ন রাখবো না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তাহলে স্যার আমার স্মরণটা ঠিক আছে!
ময়ূখ চৌধুরী: কিন্তু আবার কেউ কেউ বলেছেন, যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা।” রবীন্দ্রনাথ এইজন্য সবগুলো ছাপিয়ে দিয়েছেন। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি ২৬৩৮টা গান তাঁর পাওয়া গেছে। কিন্তু আমরা ঘুরেফিরে ৩৮টা গানই শুনি। আপনি রবীন্দ্রনাথের গানের অনুষ্ঠান দেখলে খেয়াল করবেন এই গান আপনি আগে শুনেছেন। তারমানে, ঘুরেফিরে ৩৮টা গানই শুনছেন। আর ২৬০০টা গান গেল কোথায়? “জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা”— এটা রবীন্দ্রনাথের তত্ত্ব। আমি এর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই, ‘বেছে বেছে রাখো, বাকিগুলো ফেলে দাও!’
নাজেমুল আলম মুরাদ: তাহলে স্যার আমি সমকালীন কোন কবির লেখা পড়বো? আমি আগেরগুলো পড়বো? নাকি, বর্তমানগুলো?
ময়ূখ চৌধুরী: এটার প্রসেস হচ্ছে, একটা কবিতার আপনি ফার্স্ট লাইন পড়েন, লাস্ট লাইন পড়েন। যদি দেখেন আপনাকে টানছে তখন পুরোটা পড়ে ফেলবেন। তখন ষোল লাইন পাবেন, বারো লাইন পাবেন, আঠারো লাইন পাবেন, বাইশ লাইন পাবেন, তখন পুরোটা পড়ে ফেলবেন। দেড় মিনিট করে দৈনিক যদি একটা কবিতার জন্য সময় দেন, আপনার দেড় বছর বাদে কয়টা কবিতা পড়া হলো? চিন্তা করেছেন? এক বছর বাদে ৩৬৫টা কবিতা! এবার আপনার নিজে থেকেই সেন্সটা ডেভেলপ করবে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কবিতার ব্যাপারে আমার আরেকটা কথা আছে স্যার। সুকান্তের “পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”। এখানে উনি নিজেই দেখিয়ে দিয়েছেন যে কিসের সাথে কী তুলনা করছেন।
ময়ূখ চৌধুরী: এটা গরীবের পক্ষে লেখা। উনি মার্ক্সবাদী ছিলেন। কিন্তু মার্ক্সবাদের আগে, কার্ল মার্ক্সের জন্মের আগেও তো পৃথিবীতে পেটে ক্ষুধা লাগতো, কৃষক ছিল, শ্রমিক ছিল, তাঁরা বঞ্চিত হয়েছে। তাহলে মার্ক্সবাদের আগেই মার্ক্সবাদের উপজীব্য, সাবজেক্ট ম্যাটার পৃথিবীতে তৈরি ছিল, তিনি এসে সেগুলোকে দর্শনটা দিয়েছেন।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আমি বলতে চাচ্ছি, আপনি বললেন যে এমন শব্দের ব্যবহার হবে যেটা আভিধানিক অর্থ থেকে ডিফারেন্ট হবে। এখন ডিফারেন্সটা উনি নিজে বলেও দিয়েছেন কবিতার মধ্যে। তাহলে ওটা কবিতা হয়ে উঠলো কিনা, এটাই প্রশ্ন।
ময়ূখ চৌধুরী: হ্যাঁ, হবে। উপমা নামক অলঙ্কার ব্যবহার করেছেন তিনি। একটু সাজিয়ে দিয়েছেন। মনে করেন, একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে কি আপনি জিজ্ঞেস করেন, কনে কে?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: না। এটা বুঝা যায়।
ময়ূখ চৌধুরী: কীভাবে?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সাজ দেখে।
ময়ূখ চৌধুরী: রাইট৷ এখানে সাজগোজ দেখে আপনি বুঝবেন এটাকে কবিতা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এখন “পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”, এটা কিন্তু খুব উৎকৃষ্ট কবিতার উদাহরণ নয়। তবে প্রোপাগাণ্ডা হিসেবে, দেয়াল লিখন হিসেবে, লালসালুতে লেখার জন্য এটার দরকার ছিল। সুকান্তকে যারা পপুলার করেছে, রাজনৈতিক প্রয়োজনে তাঁকে আপডেট করা হয়েছে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কেউ যদি স্যার এমন একটা লেখে যে, ‌‘তোমাকে ভালোবাসি এটার মত’। ঐযে আপনি ‘স্বাধীনতা তুমি’ সম্বন্ধে বলেছিলেন যে এটা ইলাস্টিক কবিতা। এখন স্যার ‌‘তোমাকে ভালোবাসি এটার মত, ওটার মত’ ইত্যাদি, তাহলে এটাও তো “পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”র মত হলো। তাহলে এটা কি কবিতা হবে না, যদি সেখানে হৃদয়ের একটা আবেগ প্রকাশ পায়?
ময়ূখ চৌধুরী: হবে। শব্দের ক্ষেত্রে যেটা বললাম। অভিধানের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ডিফারেন্ট মিনিং দিচ্ছে, শব্দ। যদি বাক্য দিয়ে থাকে এরকম? তখন কী করবেন?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সেই বাক্যটা কি কবিতা হয়ে উঠবে?
ময়ূখ চৌধুরী: হ্যাঁ। ঐ বাক্যটা যদি ডিকশনারি থেকে মুক্ত হয়ে অন্যদিকে চলে যায়, ব্যাকরণ থেকে মুক্ত হয়ে বাইরে চলে যায় তখন ঐটা কবিতার লাইন হবে। এবার টোটাল কবিতাটা যদি প্রথাগত মিনিং থেকে জাম্প করে তাহলে কবিতা হয়ে যাবে। কথা হচ্ছে, যা বললো তাই (যদি মিনিং হয়), তাহলে তা গদ্য। A prose says something, means the same one. One the other hand, a poetry says something, but means something else. যেমন: ‘বাসস্টপে তিন মিনিট’। ঠিকই আছে তিন মিনিট বাসস্টপে। আবার:
“বাসস্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ।”
কিছুই বলে নাই, ক্রিয়াপদ ইত্যাদি কিছুই বলে নাই। আরেক জায়গায় বলছে:
“তোমাকে যখন দেখি,
তার চেয়ে বেশি দেখি
যখন দেখি না”
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এটা কার লেখা?
ময়ূখ চৌধুরী: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: চমৎকার!
ময়ূখ চৌধুরী: “বাসস্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ”। কোনো ক্রিয়াপদ দেয়নি। এটা সাহসের ব্যাপার! আবার পরেরটাতে ক্রিয়াপদ দিয়ে, ‘দেখা’ শব্দটাকে নিয়ে খেলছে। “তোমাকে যখন দেখি তারচেয়ে বেশি দেখি যখন দেখি না”। এবার নাড়া দিচ্ছে না ভিতরে? এবার ঐ আগের অর্থগুলো মিনিংফুল হয়ে উঠেছে না? ইট ইজ পয়েট্রি! ছন্দ ভাঙা কিন্তু কঠিন। ছন্দবদ্ধ কবিতা লেখা সহজ, গদ্য ছন্দ লেখা কঠিন। গদ্য কবিতা সবাই লিখতে পারে না। আলী আহসান লিখেছেন, আব্দুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন। আপনি ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু ধোঁয়াকে ধরতে পারবেন না। কিছু কবিতা আছে ধূমায়িত কবিতা। কবিতা লেখা হয় উপলব্ধি করবার জন্য। গদ্য লেখা হয় বুঝবার জন্য। গোলাপ যে সুন্দর আপনি বুঝলেন কী করে? আরেকটা কবিতা শুনাই। “একটাই মোমবাতি” কবিতার নাম। এটা ছন্দে আছে।
“একটাই মোমবাতি, তুমি তাকে কেন দু’দিকে জ্বেলেছ?
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
তুমি এত অহঙ্কারী কেন?
চোখে চোখ রাখতে গেলে অন্য দিকে চেয়ে থাকো,
হাতে হাত রাখলে গেলে ঠেলে দাও,
হাতের আমলকী-মালা হঠাৎ টান মেরে তুমি ফেলে দাও,
অথচ তারপরে এত শান্ত স্বরে কথা বলো, যেন
কিছুই হয়নি, যেন
যা কিছু যেমন ছিল, ঠিক তেমনি আছে।
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
অথচ এমন কাণ্ড করবার এখনই কোনো দরকার ছিল না।
অন্য কিছু না থাক, তোমার
স্মৃতি ছিল; স্মৃতির ভিতরে
ভুবন-ভাসানো একটা নদী ছিল; তুমি
নদীর ভিতরে ফের ডুবে গিয়ে কয়েকটা বছর
অনায়াসে কাটাতে পারতে। কিন্তু কাটালে না;
এখনই দপ করে তুমি জ্বলে উঠলে ব্লাউজের হলুদে।
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
তুমি এত অহঙ্কারী কেন?
একটি মোমবাতি, তবু অহঙ্কারে তাকে তুমি দু’দিকে জ্বেলেছ।”
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এটা তো স্যার আপনার লেখা।
ময়ূখ চৌধুরী: না। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখা।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কিন্তু আপনার কাছ থেকে এটা আমি শুনেছি একাধিক বার।
ময়ূখ চৌধুরী: এটা আমার প্রিয় কবিতার মধ্যে একটা। আচ্ছা, পাখির ইংরেজি বার্ড। কিন্তু নাজেমুল আলম মুরাদ তো soul করে দিল। এবার আপনার মুখ থেকে অন্য আরেকটা মিনিং করবো। এটা এই গরীবের লেখা। কিন্তু ছাপা হয়নি। এটা আমি দীর্ঘকাল মুখে মুখে রেখেছি।
বুকের ভিতর একটি পাখি
দিবস রাত্রি নড়নচড়ন।
দানাপানি খায়না কিছু
কেবল তোমার পিছু পিছু।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: শেষ?
ময়ূখ চৌধুরী: শেষ। আমি আর প্রয়োজন বোধ করিনি। এটা আমি ছাপাবোও না। কিন্তু উদাহরণ দেয়ার জন্য আমার দরকার।… পাখি মানে বার্ড, পাখি মানে সৌল, এই পাখি মানে কী? এইভাবে কবিরা আপনাকে বাধ্য করবে অভিধান নির্দেশিত অর্থকে ‌‘বেয়াদবের’ মতন অস্বীকার করে আরেকটা মিনিং খুঁজতে। আরেকটা মিনিং, সেকেন্ড মিনিং, থার্ড মিনিং, অ্যানাদার মিনিং…
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্যার, আপনার কাছ থেকে আরেকটা কথা জেনে নিই। আপনাকে এই মুডে আবার কখনো পাবো কিনা সন্দেহ। সেটা হচ্ছে, আমাদের ফিলসফিতে, ওয়েস্টার্ন ফিলসফিতে বিশেষ করে এনালাইটিক ট্রেন্ডে বলা হয়, আবেগের কোনো জ্ঞানগত মূল্য নাই। কিন্তু আমি আমার অনেকগুলো লেখায় ইতোমধ্যে বলেছি, Emotion is the spawning ground of knowledge। আবেগ থেকেই সবজ্ঞান উৎপন্ন হয়। আবেগ হচ্ছে মানুষের শুদ্ধ ঠিকানা। আমি যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পড়াই সেখানে বলি, আবেগ আসে সাবজেক্টিভিটি থেকে এবং এটা মানুষ ও যন্ত্রের মূল পার্থক্য। আদমও (আ.) আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন আল্লাহর হুকুম অমান্য করতে গিয়ে। কবিতা এবং জ্ঞান বা আমাদের ফিলসফিক্যাল নলেজ যদি বলি, এই দুইটাই তো আসে মানুষের আবেগের মূল জায়গা থেকে।
ময়ূখ চৌধুরী: আবেগ তো আমরা নিয়েই জন্মাই। এটা আমাদের ইন্সটিংক্টের মধ্যে আছে। এটা আমি অর্জন করি না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: না। কোনো কিছু করার জন্য তো আপনার একটা প্রাথমিক জিনিস লাগবে যেটা দিয়ে আপনি ধরবেন। যেমন: মাছ ধরার জন্য ছাইটা তো লাগবে।
ময়ূখ চৌধুরী: কিন্তু আমার ভিতরে মনে করেন যে, আমি একটা বর্ণনা দিই- বাজারে গেলাম। যেখানে পান সুপারি বিক্রি করে সেখানে গেলাম। তার পাশে আরেকটা দোকান আছে, মুদি দোকান। সেখানে পাকা তেঁতুল বিক্রি করছে। উপরে আবার সয়াবিন তেল দিয়ে চকচকে করে রেখেছে। ওখান থেকে দাড়িগোঁফ বেরিয়েছে, শলা। একটা টোকাইমার্কা ছেলে গিয়ে আস্তে করে নখ দিয়ে এমনি করে… উমমম! তেঁতুল, তেলাপোকার মতন রঙ, পা-কা তেঁতুল! আপনার জিহ্বার তলা দিয়ে একটু ভিজা ভিজা লাগছে না এখন? কই, এখানে তেঁতুল কোথায়?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আইডিয়াটা পপ-আপ করছে মাথার মধ্যে।
ময়ূখ চৌধুরী: তেঁতুলটা খেলে আপনার যে রিয়েকশনটা হতো, সেটা কিন্তু এই বর্ণনার দ্বারা হয়ে যাচ্ছে। এরকম প্রতিটা কিছুর বর্ণনা যদি সেরকম গাঢ় এবং গভীর হয় তাহলে আপনার ইন্সটিংক্টের মাধ্যমে আপনার ইন্দ্রিয়কে নির্ভর করে, আছড় করে আপনাকে ভাবিত করবে। তখন আপনি রিয়েক্ট করবেন। এই যে এখন তেঁতুলের কথা বললাম আমার জিহ্বার তলা ভিজা। কই এখানে তেঁতুল আমরা খাইনি, দেখিওনি। শুধু বর্ণনা।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: বর্ণনাটা আমাদের ব্রেইনের মধ্যে একটা গ্রাফিক্যাল…
ময়ূখ চৌধুরী: এ যে আমাদের জিহ্বার মধ্যে ঐ ‌‘মেশিন’টা আছে এটা তেঁতুল, এটা রসগোল্লা বুঝার জন্য। তাহলে আমরা জিহ্বা, ত্বক, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা নিয়ে জন্মগ্রহণ করছি। কোনটা হাসনাহেনা, কোনটা গোলাপ ডিফারেন্সিয়েট যে আমরা করতে পারছি তা এই যন্ত্র দিয়ে। যেটা নিয়ে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি। ওই যন্ত্রগুলোকে ব্যবহার করে আমার যন্

Recent Post

সুভা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর   জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ১. সুভার বাবার নাম কি? ২. সুভা কোথায় বসে থাকত? ৩. সুভা জলকুমারী হলে কী করত? ৪. সুভার গ্রামের নাম কী? ৫...

Most Popular Post