Ad-1

Sunday, November 1, 2020

গদ্য, পদ্য ও কবিতা ময়ুখ চৌধুরী

[কবি ময়ুখ চৌধুরী আশির দশক থেকে সাহিত্যকর্মে নিজস্ব কাব্যস্বরের জন্য সুপরিচিত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ১০টি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে চার দশক অধ্যাপনার পর বর্তমানে অবসরে আছেন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে চবি শিক্ষক লাউঞ্জে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক জনাব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ও জনাব নাজেমুল আলম মুরাদ-এর সাথে তিনি গদ্য, পদ্য ও কবিতা নিয়ে খোলামেলা কিছু কথাবার্তা বলেন। এটি সেই আলাপচারিতার পরিমার্জিত অনুলিখন।]

***
ময়ূখ চৌধুরী: আমি যেটা বলছি, এটা নিছক কোনো বই পড়া বিদ্যা নয়। দীর্ঘদিনের অধ্যয়ন, অনুশীলন, তৎপরতা— এগুলোর মাধ্যমে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সে অভিজ্ঞতার আলোকে কথা বলছি। আমি যে কথা বলবো সেগুলো কোনোদিন লিখিত হবে, সেগুলো পড়ে কেউ জানবে। আবার কেউ লিখে গিয়েছিল, সেটা পড়ে আমি জেনেছি।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্যার, আমরা জানতে চেয়েছিলাম, পদ্য এবং কবিতার মধ্যে পার্থক্য কী?
ময়ূখ চৌধুরী: পদ্যের মধ্যে একটা য-ফলা দেখছেন না? এই য-ফলাটা একটা প্রত্যয়। প্রকৃতি-প্রত্যয়। প্রকৃতি মানে হচ্ছে গাছ। প্রত্যয় হচ্ছে করাত। সাধিত শব্দ হচ্ছে জানালা। গাছ আর কাঠ এক জিনিস নয়। গাছ থেকে যে কাঠ হলো, নিশ্চয় কোনো একটা প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে তার সঙ্গে। এ প্রত্যয় কোনো একটা ইন্সট্রুমেন্ট হতে পারে। করাত হতে পারে, হাতুড়ি হতে পারে। কাঠটা যে টেবিল হলো, রূপান্তরিত হলো, প্রতিটি রূপান্তরের পিছনে কিছু না কিছু যুক্ত হচ্ছে। যেমন, শ্রম। এই শ্রম উপকরণ যোগে অথবা উপকরণ ছাড়া, উপাদান যোগে বা উপাদান ছাড়া যুক্ত হচ্ছে। গাছ ® কাঠ ® টেবিল।
একটা গাছ কখনো নিজে নিজে টেবিল হতে পারে না। তার সঙ্গে মানবগুণের প্রত্যয় যুক্ত হয়ে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় তখন সেটি অর্থনীতির ভাষায় ‌‘পণ্য’ হয়। তাহলে পদ্যের মধ্যে য-ফলা যুক্ত হয়ে যে পদ্য হলো, রূপায়ন হলো, সেখান থেকে য-ফলাটা তুলে নিলে থাকে পদ। পদ মানে হচ্ছে পা। এই আলোচনায় ব্যাকরণের পদ পরে আসবে। কারণ, ব্যাকরণ সৃষ্টি হয়েছে ভাষা সৃষ্টির বহুকাল বাদে। আইন সৃষ্টি হয়েছে বহু পরে। আগে মানব সমাজ তৈরি হয়েছে। সমাজের নর্মস, টেস্ট, টেম্পারমেন্ট, অ্যাটিচিউড সবকিছু মিলিত হয়ে যখন একটা মৌখিক সংবিধান তৈরি হয়, সেটা হচ্ছে কালচার। কালচারটাকে আরো সঙ্গতি দিয়ে আইন তৈরি করা হয়।
তাহলে যেদিন আমাদের সমাজে একটা শব্দ তৈরি হলো ‘পদ’, তখন পদ মানে ছিল পা। মানুষ প্রথমে যা দেখে তার নামকরণ করে। এটা সবুজ, সবুজ থেকে সবজি হয়েছে। এটা কী রং? হলুদ রং। নিশ্চয় হলুদের মতো রং। তাহলে হলুদ তো আগে প্রকৃতিতে থাকতে হবে। কোনো কিছু কমলা রং হওয়ার জন্য কমলা আগে প্রকৃতিতে থাকতে হবে। তারপর আমরা কমলা রং বলবো। কোনো কিছু খয়েরী রং হওয়ার জন্য আগে পানের সঙ্গে যে খয়ের মিশায়, ওটা থাকতে হবে। তারপর বলবো যে খয়েরী রং। এই যে শব্দগুলো তৈরি হচ্ছে সেটি আগে বস্তুগতভাবে জন্ম নিচ্ছে। তারপর তার নামকরণ করা হচ্ছে। যেমন আমার একটি কবিতা আছে—
হরিণকে যে হরিণ বলি
হরিণ কি তা জানে?
পদ্মা নদী ভেসে গেলো
চর্যাপদের টানে।
হরিণ জানে না যে আমরা তাকে হরিণ নামে নামকরণ করেছি।
প্রশ্ন: প্রাণীটা কী রকম?
উত্তর: হরিণের মতো সুন্দর।
তারমানে হরিণ নয়, হরিণের মতো।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্যার, পদের কথা বলছিলেন।
ময়ূখ চৌধুরী: প্রথমত, পদ মানে পা। তাহলে এই পদের কাজ কী? এর মাধ্যমে আমি দাঁড়াতে পারি, হাঁটতে পারি। এইবার ব্যাকরণবিদরা ব্যাকরণের কোনো একটা অধ্যায়ের নাম দিচ্ছেন ‘পদ’। নিশ্চয় তারা জানেন যে এর আগে পদ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে পা অর্থে। তাহলে বাক্যের অন্তর্গত বিভক্তিযুক্ত প্রত্যেকটি শব্দকে যে পদ বলছে, কেন বলছে? পরে দেখলাম, শব্দ বিভক্তিযুক্ত হয়ে হাঁটতে আরম্ভ করে। হাঁটা শেষ হয় দাঁড়িতে গিয়ে। তখন সে একটা ভাব প্রকাশ করে। এই পদনির্ভর অন্ত্যমিল যুক্ত যে ম্যাসেজ বা ভাবনা, সেটাই পদ্য। কিন্তু পদ্যের একটা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে পদ্য প্রতিটি শব্দকে ব্যবহার করে অভিধানে নির্দেশিত অর্থ অনুযায়ী। অথবা অভিধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ অর্থ অনুযায়ী। সেটা পদ্য।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: পদ্যের মধ্যে অন্ত্যমিল থাকলেও সেটা কবিতা হবে না। যদি সেটাতে কোনো দূরবর্তী অর্থবোধকতা না থাকে।
ময়ূখ চৌধুরী: হ্যাঁ। অন্ত্যমিল থাকলেও সেটা কবিতা হবে না। এবার একটা পদ্যের উদাহরণ দিই। তত্ত্ব না বলে আগে উদাহরণ দেয়া ভালো। তারপর বিশ্লেষণ করা ভালো। বাল্যশিক্ষার মধ্যে একটা পদ্য আছে, যেটাকে আমরা দীর্ঘদিন কবিতা বলে জেনেছি, পড়েছি, শ্রদ্ধা করেছি:
“পাখি সব করে রব রাতি পোহাইলো
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল।”
এটি লিখেছেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। তিনি বুদ্ধিমান। ভালো কাজ করেছেন। তথাকথিত কবিতাটা বা পদ্যটার নাম দিয়েছেন ‘প্রভাত বর্ণনা’। Just a description or statement. Not creation. এবার “পাখি সব করে রব রাতি পোহাইলো”— এই পাখির নিচে আন্ডারলাইন করি। এটার ইংরেজি মিনিংটা কী? বার্ড। পাখিসব আওয়াজ করছে সকালবেলা, রাত শেষ হয়ে গেছে। আর কাননে কুসুমগুলো প্রস্ফূটিত হয়েছে। এটি হলো পদ্যের সুস্পষ্ট উদাহরণ।
এবার আরেকটা রচনায় আমরা ‘পাখি’ শব্দটার ব্যবহার দেখি:
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মনবেড়ি
দিতাম পাখির পায়।”
এবার এখানে পাখির নিচে যে আন্ডারলাইন করলেন, এটার ইংরেজি মিনিং কী?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এখানে তো স্যার সিমিলিটা চলে আসছে। এটা ডিস্ট্যান্ট মিনিংয়ে চলে গেছে। গ্রামাটিক্যাল মিনিং আর নাই।
ময়ূখ চৌধুরী: দিস ইজ কারেক্ট। আমরা বুঝতে পারছি, এখানে পাখি বলতে আত্মার কথা বুঝানো হচ্ছে। দেহ-খাঁচার ভেতর ঢুকছে আর বেরুচ্ছে কীভাবে? আই ডোন্ট নো। কেমনে আসে যায়। এটা একটা বিরাট বিস্ময়।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এখানে স্যার পাখিটা অচিনের সাথে মিলে অর্থটা তৈরি করেছে।
ময়ূখ চৌধুরী: অচিন পাখি। মানে আত্মা, soul। পৃথিবীর কোনো ডিকশনারিতে কি আছে, পাখি মানে soul? তাহলে লালন ফকির ‘অশিক্ষিত’ হয়েও, অর্থাৎ আমাদের ভাষায় ইউনিভার্সিটির ছাত্র না হয়েও পাখিটাকে নিজের অর্থে ব্যবহার করেছেন। সেখান থেকে আরেকটা মিনিং বের করে দিয়েছেন। কীভাবে? ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। তার কবিতার লাইনে এমনভাবে তিনি শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন, তখন সেটি ডিকশনারির অর্থ থেকে কই মাছের মতো লাফ দিয়ে বাইরে চলে গেছে, এস্কেপ করেছে। এই যে অভিধানে নির্দেশিত অর্থ থেকে মুক্ত হয়ে ভিন্ন অর্থে যখন এক বা একাধিক কিংবা ততোধিক শব্দ প্রকাশ করবে, তখন সেটা কবিতার শব্দ হবে। এ রকম শব্দ যদি না থাকে তাহলে সেটা কবিতা হবে না
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তাহলে স্যার অন্ত্যমিলের ব্যাপারটা?
ময়ূখ চৌধুরী: অন্ত্যমিলের কোনো প্রয়োজন নাই। নামতার মধ্যেও তো অন্ত্যমিল আছে।
এক একে এক
দুই দুগুণে চার
চার দুগুণে আট
দশ দুগুণে বিশ।
এখানে ছন্দ মিলছে তো! (কিন্তু সেটি তো কবিতা হয়ে উঠছে না।)
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্যার, আপনি কবিতার ব্যাপারে যেটা বললেন, এই ধরনের অর্থবোধক, ডিস্ট্যান্ট মিনিং…
ময়ূখ চৌধুরী: ডিস্ট্যান্ট মিনিং না। অভিধানের শাসনমুক্ত।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: রূপক?
ময়ূখ চৌধুরী: রূপকও না। রূপক নিয়ে পরে আলোচনা করবো। অভিধান শাসিত অর্থ থেকে মুক্ত হয়ে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করা। ডিফারেন্ট মিনিং। ডিসট্যান্ট বলবেন না, ডিফারেন্ট।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ডিফারেন্ট। আচ্ছা, ঠিক আছে। ডিফারেন্ট এবং ডিসট্যান্ট এক নয় স্যার। ঠিক আছে। ডিফারেন্ট মিনিং নিয়ে আসলে তখন সেটা…
ময়ূখ চৌধুরী: (তখন সেটা) কবিতার শব্দ হবে। আর এরকম শব্দ সংবলিত যেকোনো রচনা— ছন্দ থাক বা না থাক, অন্ত্যমিল থাক বা না থাক— ওটা কবিতা হবে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আরেকটা জিনিস আমরা দেখি যে কবিতার বাক্যগুলো ডায়লগের মতো ভাঙা ভাঙা হয়।
ময়ূখ চৌধুরী: হ্যাঁ, হতে পারে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: যদি কেউ ডায়ালগের মতো না ভাঙলো, কিন্তু লেখার মধ্যে একটা রিদম আছে এবং…
ময়ূখ চৌধুরী: না, টানা গদ্য। ক্লোজড ভার্স। আমি গদ্যের মাধ্যমে বললাম।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: গদ্যের মাধ্যমে কি কবিতা হয়, স্যার?
ময়ূখ চৌধুরী: হয়। ২০০ বছর আগে ফ্রান্সে হয়ে গেছে। ফ্রি ভার্স।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ফ্রি ভার্স?
ময়ূখ চৌধুরী: আমার যে বইটি বেরুলো ‘চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডুহীন’ (এটি গদ্যকবিতার বই)।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আচ্ছা স্যার, আমাদের পাঠ্যবইয়ের মধ্যে যে ভাগ করা হতো— প্রোজ অ্যান্ড পয়েট্রি…
ময়ূখ চৌধুরী: ওটা মোটাদাগে বলা হতো। প্রোজ মানে কী? ফিকশন? শর্ট স্টোরি? নভেল? অ্যাসে?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: না।
ময়ূখ চৌধুরী: তাহলে? মোটাদাগে বলা হয়েছে প্রোজ। মোটাদাগে বলা হয়েছে পয়েট্রি।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তাহলে পয়েট্রির মধ্যে পদ্য ইনক্লুডেড?
ময়ূখ চৌধুরী: ইনক্লুডেড। ওটা(ভাগাভাগি) সিলেবাসওয়ালারা করেছেন। সিলেবাস তো আমাদের কাছে মাননীয় না৷ কারণ, পৃথিবীর প্রথম কাব্য যারা লিখেছেন তাদের কোনো সিলেবাস ছিলো না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এটা নিয়ে ঐদিন রাতে কথা বলেছিলেন। মহাকাব্য কীভাবে লেখা হয়েছে সে অনুসারে এখন আমরা মহাকাব্যের হদিস বের করছি কীভাবে কী হয়েছে। কিন্তু প্রথম মহাকাব্য যিনি লিখেছেন…
ময়ূখ চৌধুরী: তিনি তো জানতেন না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল রিসার্চ মেথডলজি। আমরা কাজ করি হিউম্যান রিলেশন নিয়ে, কনসেপ্ট নিয়ে। আমাদের (রিসার্চে) তো কোনো এম্পেরিক্যাল ডাটা নাই।
ময়ূখ চৌধুরী: ফিলসফির চিন্তা মাত্র দুইটা জিনিস নিয়ে। এক হচ্ছে জীবন কী, দুই হচ্ছে জগৎ কী। খুব ছোট সিলেবাস। কেউ বলতে পারেন, এগুলোকে ‘ছোট’ বলছেন কেন? (আমার উত্তর হলো) কিন্তু এরমধ্যে তো সবই আছে। ফিলসফির বাইরে কী আছে?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনি তখন বলেছিলেন, রিসার্চ মেথডলিজর কথা যারা বলছেন, সেই রিসার্চ মেথডলজি তৈরি হওয়ার আগে রিসার্চ কীভাবে হয়েছে? আর রিসার্চ মেথডলজি একটা হওয়ার পরে কেন পরবর্তীতে আরো কয়েকটা হয়েছে?
ময়ূখ চৌধুরী: পৃথিবীতে যিনি প্রথম পিএইচডি করেছেন তিনি কি কোনো পিএইচডি হোল্ডারের আন্ডারে পিএইচডি করেছেন?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনি তখন বলেছিলেন, কিছু হচ্ছে মৌলিক রচনা। সেগুলোতে উদ্ধৃতি দেয়া, মেথডলজি ফলো করা ইত্যাদি থাকে না, দরকার হয় না। তার মানে কি স্যার আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মই করি দিয়েছি ‘‌‌‌তোমাকে মিডিওকার হতে হবে? তুমি প্রাইমারি হতে পারবে না! হলে তুমি ডিগ্রি পাবে না! তোমার লেখায় যদি উদ্ধৃতি না থাকে, কোনো ফরম্যাট না থাকে তাহলে তোমার লেখাটা লেখাই হয় নাই!’ অথচ মৌলিক লেখা, কথার কথা রবীন্দ্রনাথের লেখায়, কী মেথডলজি ফলো করা হয়েছে? আমরাই বের করছি মেথডলজি কী…।
ময়ূখ চৌধুরী: আমরাই রবীন্দ্রনাথের লেখাকে উদ্ধৃতিতে নিয়ে আসছি। রবীন্দ্রনাথ তো কোনো উদ্ধৃতি চিহ্ন দেননি। এমন আরেকজন হচ্ছেন হুমায়ুন কবির। পশ্চিম বাংলার। তিনি ‘বাংলার কাব্য’ নামে ছোট একটা বই লিখেছেন। কোনো উদ্ধৃতি চিহ্ন নেই। সব তাঁর নিজের কথা।
নাজেমুল আলম মুরাদ: হুমায়ুন কবির বলতে ‘নদী ও নারী’ যিনি…
ময়ূখ চৌধুরী: ‘নদী ও নারী’ লিখেছেন। তো, কবিতা হচ্ছে মানুষের অনুভূতির একেবারে মোস্ট পারফেক্ট অংশটাকে শব্দে রূপ দেওয়া। সুরে রূপ দিলে মিউজিক হবে, শব্দে রূপ দিলে কবিতা হবে, রঙে রূপ দিলে পেইন্টিং হবে। সবগুলোই একই জিনিস। মানুষের যে উপলব্ধি, অনুভূতি, পর্যবেক্ষণ, কল্পনা এবং সর্বশেষ ইনটুইশান(স্বজ্ঞা)…। ইনটুইশান হচ্ছে ‘ফানাফিল্লাহ’। এরপরে আর নাই। এইসবগুলোকে একেবারে জমাট করে মিনিমাম কথার মধ্যে বেশি কথা বলতে পারে কবিতা। আর এটাকে ইলাবোরেট করলে তা ফিলসফি হয়ে ওঠে।
নাজেমুল আলম মুরাদ: তাহলে স্যার আপনার কবিতা হচ্ছে দর্শনের কাব্যিক রূপ?
ময়ূখ চৌধুরী: দর্শন তো সবাই করে। এটা তো দার্শনিকরাই বলেন, সবাই কমবেশি নিজে নিজে দার্শনিক। যেমন, আমি বলি। আমার গায়ে এখন উত্তাপ আছে। মাপলে কত দাঁড়াবে? নাইনটি এইট পয়েন্ট এক্স, আমি পরিষ্কার জানি না কত। এর সঙ্গে মাত্র ১ ডিগ্রি যোগ করলাম। ডাক্তার এসে বলবে জ্বর কত? তখন আমার ঘরের লোকজন বলবে ৯৯ ডিগ্রি। ৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট জ্বর! আচ্ছা ৯৯ ডিগ্রি জ্বর হলে ঐ জ্বর থেকে ১ ডিগ্রি মাইনাস করো। ৯৮ ডিগ্রি। তখন কী হবে? বলবে যে উত্তাপ। এতক্ষণ বলছে উত্তাপ, ১ ডিগ্রি যোগ করলে বলছে জ্বর। তার মানে, আমরা সবাই ফিলসফার ৯৮ পর্যন্ত।
নাজেমুল আলম মুরাদ: (মোজাম্মেল) স্যারের কথা একটা মনে পড়ছে…
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: Everyone does philosophy, but only a few are aware of doing this!
নাজেমুল আলম মুরাদ: স্যার আপনি ক্লাসে একবার বলেছিলেন, কতটুকু হলে আমি ঠাণ্ডা বলবো, কতটুকু হলে আমি গরম বলবো, তা আমার মনে আছে স্যার। আপনি এসির তাপমাত্রা নিয়ে কথা বলেছিলেন।
ময়ূখ চৌধুরী: তাপমাত্রার একটা প্যারামিটার তৈরি করে দিয়েছে সায়েন্স। ৯৮ ডিগ্রি বা এত পর্যন্ত উত্তাপ, ১ ডিগ্রি যোগ করলে আমরা বলছি জ্বর।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আমার শিক্ষকতা জীবনের যেসব প্রাপ্তি তার মধ্যে অন্যতম একটা হচ্ছে আমি ময়ূখ চৌধুরীর একজন প্রিয়-মানুষ হতে পেরেছি এবং কাছাকাছি হতে পেরেছি। স্যারের মত হতে চাই। এবং এরকম মানুষ ছিল প্রফেসর ওয়াহেদুর রহমান স্যার। আমাদের ওয়াহেদুর রহমান স্যার এরকম জাত শিক্ষক ছিলেন। উনি যখন ক্লাস নিতেন তখন উনি সবকিছু হারিয়ে ফেলতেন। উনি আমাদেরকে বলতেন, “শুনো, আমি দুইটা সময়ে জীবনের দুঃখ সব ভুলে যাই। যখন আমি নামাজ পড়ি এবং যখন আমি ক্লাস নিই।” মিডিওকার স্টুডেন্টরা উনাকে বুঝতে পারতো না।
ময়ূখ চৌধুরী: যা হোক, কবিতার ব্যাপার হচ্ছে, সমকালে প্রচুর কবিতা লেখা হবে। কিন্তু ১০ থেকে ২০ বছর পরে অনেকে লেখা বন্ধ করে দিবেন। আজকের দুর্বল কবিতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত কবিদের ভালো কবিতার তুলনা করে আমরা বলি, ‌’এগুলো কি কবিতা নাকি?’
আমিও তো বলছি এগুলো কবিতা না। রবীন্দ্রনাথের সময়ে কেউ কবিতা লেখেনি? সেগুলো কই? সবকালে কিছু কবিতা লেখা হবে পাতার মত। কিন্তু ফুল ফুটবে কম। একটা গাছের সবগুলো ফুল হয় না। পাতা হয় বেশি। ঐ পাতাগুলোর দরকার আছে ফুলকে ঝড়ঝাপটা, অতিবৃষ্টি, অতিরোদ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। ফুল কম ফুটবে, ফল আরো কম হবে। রবীন্দ্রনাথের আমলে যারা লিখেছেন, নজরুলের আমলে যারা লিখেছেন তারা কোথায়? কেউ নাই। ইতিহাস হচ্ছে নির্মম ঝাড়ুদার। সে ঝাড়ু দিয়ে সব পরিস্কার করে দিবে। কিছু রেখে দিবে।
নাজেমুল আলম মুরাদ: ঝাড়ু দেয়ার জন্য পাতা তো লাগবেই।
ময়ূখ চৌধুরী: লাগবে। আজকের দুর্বল কবিতাগুলো সামনে রেখে ‌‘হোয়াট ইজ পোয়েট্রি’ বিচার করবেন না। আজকে যারা ভালো লিখছে, জিজ্ঞেস করেন, আপনি যদি না জানেন এক্সপার্ট একজনকে জিজ্ঞেস করেন, কারগুলো পড়বো, কারগুলো পড়বো না। তখন দেখবেন যে আপনার সিলেবাস ছোট হয়ে আসছে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্যার আপনার কথাটা যদি একটু রিপিট করেন যে, আজকেরগুলোর প্রেক্ষাপটে আমরা অতীতেরগুলোকে…। এখন থেকে ১০-২০ বছর পরে এখনকার লোকেদের লেখা কতটুকু টিকবে সেটা অনুসারে বুঝা যাবে এটা আসলে কবিতা হয়ে উঠছে কিনা। তাই তো?
ময়ূখ চৌধুরী: হ্যাঁ। যেমন ’৩০ এর কবিতার মধ্যে জীবনানন্দ দাশ টিকে রয়েছেন। ৮ দশক আগের এক ‌‘বনলতা সেন’ মাস্টারপিস দিয়ে। সুধীন দত্ত টিকে আছেন ‌‘উটপাখি’র জন্য। বুদ্ধদেব বসু কবি হিসেবে না, অন্য হিসেবে টিকে আছেন। ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক হিসেবে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্যার আপনি যেটা বললেন, এটা কি একজন কবির জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে যে, তিনি অনেক লিখবেন, কিন্তু তাঁর সবলেখা…?
ময়ূখ চৌধুরী: হ্যাঁ, অনেক লিখবেন, সবলেখা ততটা মানসম্পন্ন হবে না। আমি তো বলছি, আমি পাতার মত অনেক লিখি, পাতার মত অনেক ছাপি। কিন্তু বই করার সময় আমি ফুলগুলো বেছে বেছে ‌‘দেবতাকে পূজা দিই’, ওখানে পাতা দেই না। এটাই নিয়ম। আপনি কোনো একটা ভালো অনুষ্ঠানে গেলে চুজি হয়ে থাকেন আপনার পোষাকের ব্যাপারে। স্যুট-টাই কমপ্লিট পরে তারপর আপনি যান।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্যার আরেকটা হলো, যারা লিখেন, আপনিসহ, আমরা বিশেষ করে নজরুলের অনেক পাণ্ডুলিপি দেখি, বা অনেকেরই, সেখানের মধ্যে অনেক কাটাকাটি দেখি।
ময়ূখ চৌধুরী: রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ সবাই কাটাকাটি করেছেন। সবচেয়ে বেশি কাটাকাটি করেছেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনি একটা কথা একবার আমাকে বলেছিলেন। আমি এক্সাক্টলি স্মরণ করতে পারছি না। ভুল হলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং সংশোধন করে দিবেন। আপনি বলেছিলেন, ‌‘আমার পাণ্ডুলিপি আমি কাউকে দেখাই না, কারণ আমার কাটাগুলো যাতে লোকেরা না দেখে এবং আমাকে আন্ডারমাইন যাতে না করে।’
ময়ূখ চৌধুরী: আমার অপ্রকাশিত লেখাগুলো, যেগুলো ছাপাইনি, সেগুলো আমি পুড়িয়ে ফেলবো। আমার দুর্বলতার চিহ্ন রাখবো না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তাহলে স্যার আমার স্মরণটা ঠিক আছে!
ময়ূখ চৌধুরী: কিন্তু আবার কেউ কেউ বলেছেন, যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা।” রবীন্দ্রনাথ এইজন্য সবগুলো ছাপিয়ে দিয়েছেন। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি ২৬৩৮টা গান তাঁর পাওয়া গেছে। কিন্তু আমরা ঘুরেফিরে ৩৮টা গানই শুনি। আপনি রবীন্দ্রনাথের গানের অনুষ্ঠান দেখলে খেয়াল করবেন এই গান আপনি আগে শুনেছেন। তারমানে, ঘুরেফিরে ৩৮টা গানই শুনছেন। আর ২৬০০টা গান গেল কোথায়? “জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা”— এটা রবীন্দ্রনাথের তত্ত্ব। আমি এর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই, ‘বেছে বেছে রাখো, বাকিগুলো ফেলে দাও!’
নাজেমুল আলম মুরাদ: তাহলে স্যার আমি সমকালীন কোন কবির লেখা পড়বো? আমি আগেরগুলো পড়বো? নাকি, বর্তমানগুলো?
ময়ূখ চৌধুরী: এটার প্রসেস হচ্ছে, একটা কবিতার আপনি ফার্স্ট লাইন পড়েন, লাস্ট লাইন পড়েন। যদি দেখেন আপনাকে টানছে তখন পুরোটা পড়ে ফেলবেন। তখন ষোল লাইন পাবেন, বারো লাইন পাবেন, আঠারো লাইন পাবেন, বাইশ লাইন পাবেন, তখন পুরোটা পড়ে ফেলবেন। দেড় মিনিট করে দৈনিক যদি একটা কবিতার জন্য সময় দেন, আপনার দেড় বছর বাদে কয়টা কবিতা পড়া হলো? চিন্তা করেছেন? এক বছর বাদে ৩৬৫টা কবিতা! এবার আপনার নিজে থেকেই সেন্সটা ডেভেলপ করবে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কবিতার ব্যাপারে আমার আরেকটা কথা আছে স্যার। সুকান্তের “পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”। এখানে উনি নিজেই দেখিয়ে দিয়েছেন যে কিসের সাথে কী তুলনা করছেন।
ময়ূখ চৌধুরী: এটা গরীবের পক্ষে লেখা। উনি মার্ক্সবাদী ছিলেন। কিন্তু মার্ক্সবাদের আগে, কার্ল মার্ক্সের জন্মের আগেও তো পৃথিবীতে পেটে ক্ষুধা লাগতো, কৃষক ছিল, শ্রমিক ছিল, তাঁরা বঞ্চিত হয়েছে। তাহলে মার্ক্সবাদের আগেই মার্ক্সবাদের উপজীব্য, সাবজেক্ট ম্যাটার পৃথিবীতে তৈরি ছিল, তিনি এসে সেগুলোকে দর্শনটা দিয়েছেন।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আমি বলতে চাচ্ছি, আপনি বললেন যে এমন শব্দের ব্যবহার হবে যেটা আভিধানিক অর্থ থেকে ডিফারেন্ট হবে। এখন ডিফারেন্সটা উনি নিজে বলেও দিয়েছেন কবিতার মধ্যে। তাহলে ওটা কবিতা হয়ে উঠলো কিনা, এটাই প্রশ্ন।
ময়ূখ চৌধুরী: হ্যাঁ, হবে। উপমা নামক অলঙ্কার ব্যবহার করেছেন তিনি। একটু সাজিয়ে দিয়েছেন। মনে করেন, একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে কি আপনি জিজ্ঞেস করেন, কনে কে?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: না। এটা বুঝা যায়।
ময়ূখ চৌধুরী: কীভাবে?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সাজ দেখে।
ময়ূখ চৌধুরী: রাইট৷ এখানে সাজগোজ দেখে আপনি বুঝবেন এটাকে কবিতা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এখন “পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”, এটা কিন্তু খুব উৎকৃষ্ট কবিতার উদাহরণ নয়। তবে প্রোপাগাণ্ডা হিসেবে, দেয়াল লিখন হিসেবে, লালসালুতে লেখার জন্য এটার দরকার ছিল। সুকান্তকে যারা পপুলার করেছে, রাজনৈতিক প্রয়োজনে তাঁকে আপডেট করা হয়েছে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কেউ যদি স্যার এমন একটা লেখে যে, ‌‘তোমাকে ভালোবাসি এটার মত’। ঐযে আপনি ‘স্বাধীনতা তুমি’ সম্বন্ধে বলেছিলেন যে এটা ইলাস্টিক কবিতা। এখন স্যার ‌‘তোমাকে ভালোবাসি এটার মত, ওটার মত’ ইত্যাদি, তাহলে এটাও তো “পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”র মত হলো। তাহলে এটা কি কবিতা হবে না, যদি সেখানে হৃদয়ের একটা আবেগ প্রকাশ পায়?
ময়ূখ চৌধুরী: হবে। শব্দের ক্ষেত্রে যেটা বললাম। অভিধানের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ডিফারেন্ট মিনিং দিচ্ছে, শব্দ। যদি বাক্য দিয়ে থাকে এরকম? তখন কী করবেন?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সেই বাক্যটা কি কবিতা হয়ে উঠবে?
ময়ূখ চৌধুরী: হ্যাঁ। ঐ বাক্যটা যদি ডিকশনারি থেকে মুক্ত হয়ে অন্যদিকে চলে যায়, ব্যাকরণ থেকে মুক্ত হয়ে বাইরে চলে যায় তখন ঐটা কবিতার লাইন হবে। এবার টোটাল কবিতাটা যদি প্রথাগত মিনিং থেকে জাম্প করে তাহলে কবিতা হয়ে যাবে। কথা হচ্ছে, যা বললো তাই (যদি মিনিং হয়), তাহলে তা গদ্য। A prose says something, means the same one. One the other hand, a poetry says something, but means something else. যেমন: ‘বাসস্টপে তিন মিনিট’। ঠিকই আছে তিন মিনিট বাসস্টপে। আবার:
“বাসস্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ।”
কিছুই বলে নাই, ক্রিয়াপদ ইত্যাদি কিছুই বলে নাই। আরেক জায়গায় বলছে:
“তোমাকে যখন দেখি,
তার চেয়ে বেশি দেখি
যখন দেখি না”
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এটা কার লেখা?
ময়ূখ চৌধুরী: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: চমৎকার!
ময়ূখ চৌধুরী: “বাসস্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ”। কোনো ক্রিয়াপদ দেয়নি। এটা সাহসের ব্যাপার! আবার পরেরটাতে ক্রিয়াপদ দিয়ে, ‘দেখা’ শব্দটাকে নিয়ে খেলছে। “তোমাকে যখন দেখি তারচেয়ে বেশি দেখি যখন দেখি না”। এবার নাড়া দিচ্ছে না ভিতরে? এবার ঐ আগের অর্থগুলো মিনিংফুল হয়ে উঠেছে না? ইট ইজ পয়েট্রি! ছন্দ ভাঙা কিন্তু কঠিন। ছন্দবদ্ধ কবিতা লেখা সহজ, গদ্য ছন্দ লেখা কঠিন। গদ্য কবিতা সবাই লিখতে পারে না। আলী আহসান লিখেছেন, আব্দুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন। আপনি ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু ধোঁয়াকে ধরতে পারবেন না। কিছু কবিতা আছে ধূমায়িত কবিতা। কবিতা লেখা হয় উপলব্ধি করবার জন্য। গদ্য লেখা হয় বুঝবার জন্য। গোলাপ যে সুন্দর আপনি বুঝলেন কী করে? আরেকটা কবিতা শুনাই। “একটাই মোমবাতি” কবিতার নাম। এটা ছন্দে আছে।
“একটাই মোমবাতি, তুমি তাকে কেন দু’দিকে জ্বেলেছ?
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
তুমি এত অহঙ্কারী কেন?
চোখে চোখ রাখতে গেলে অন্য দিকে চেয়ে থাকো,
হাতে হাত রাখলে গেলে ঠেলে দাও,
হাতের আমলকী-মালা হঠাৎ টান মেরে তুমি ফেলে দাও,
অথচ তারপরে এত শান্ত স্বরে কথা বলো, যেন
কিছুই হয়নি, যেন
যা কিছু যেমন ছিল, ঠিক তেমনি আছে।
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
অথচ এমন কাণ্ড করবার এখনই কোনো দরকার ছিল না।
অন্য কিছু না থাক, তোমার
স্মৃতি ছিল; স্মৃতির ভিতরে
ভুবন-ভাসানো একটা নদী ছিল; তুমি
নদীর ভিতরে ফের ডুবে গিয়ে কয়েকটা বছর
অনায়াসে কাটাতে পারতে। কিন্তু কাটালে না;
এখনই দপ করে তুমি জ্বলে উঠলে ব্লাউজের হলুদে।
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
তুমি এত অহঙ্কারী কেন?
একটি মোমবাতি, তবু অহঙ্কারে তাকে তুমি দু’দিকে জ্বেলেছ।”
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এটা তো স্যার আপনার লেখা।
ময়ূখ চৌধুরী: না। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখা।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কিন্তু আপনার কাছ থেকে এটা আমি শুনেছি একাধিক বার।
ময়ূখ চৌধুরী: এটা আমার প্রিয় কবিতার মধ্যে একটা। আচ্ছা, পাখির ইংরেজি বার্ড। কিন্তু নাজেমুল আলম মুরাদ তো soul করে দিল। এবার আপনার মুখ থেকে অন্য আরেকটা মিনিং করবো। এটা এই গরীবের লেখা। কিন্তু ছাপা হয়নি। এটা আমি দীর্ঘকাল মুখে মুখে রেখেছি।
বুকের ভিতর একটি পাখি
দিবস রাত্রি নড়নচড়ন।
দানাপানি খায়না কিছু
কেবল তোমার পিছু পিছু।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: শেষ?
ময়ূখ চৌধুরী: শেষ। আমি আর প্রয়োজন বোধ করিনি। এটা আমি ছাপাবোও না। কিন্তু উদাহরণ দেয়ার জন্য আমার দরকার।… পাখি মানে বার্ড, পাখি মানে সৌল, এই পাখি মানে কী? এইভাবে কবিরা আপনাকে বাধ্য করবে অভিধান নির্দেশিত অর্থকে ‌‘বেয়াদবের’ মতন অস্বীকার করে আরেকটা মিনিং খুঁজতে। আরেকটা মিনিং, সেকেন্ড মিনিং, থার্ড মিনিং, অ্যানাদার মিনিং…
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্যার, আপনার কাছ থেকে আরেকটা কথা জেনে নিই। আপনাকে এই মুডে আবার কখনো পাবো কিনা সন্দেহ। সেটা হচ্ছে, আমাদের ফিলসফিতে, ওয়েস্টার্ন ফিলসফিতে বিশেষ করে এনালাইটিক ট্রেন্ডে বলা হয়, আবেগের কোনো জ্ঞানগত মূল্য নাই। কিন্তু আমি আমার অনেকগুলো লেখায় ইতোমধ্যে বলেছি, Emotion is the spawning ground of knowledge। আবেগ থেকেই সবজ্ঞান উৎপন্ন হয়। আবেগ হচ্ছে মানুষের শুদ্ধ ঠিকানা। আমি যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পড়াই সেখানে বলি, আবেগ আসে সাবজেক্টিভিটি থেকে এবং এটা মানুষ ও যন্ত্রের মূল পার্থক্য। আদমও (আ.) আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন আল্লাহর হুকুম অমান্য করতে গিয়ে। কবিতা এবং জ্ঞান বা আমাদের ফিলসফিক্যাল নলেজ যদি বলি, এই দুইটাই তো আসে মানুষের আবেগের মূল জায়গা থেকে।
ময়ূখ চৌধুরী: আবেগ তো আমরা নিয়েই জন্মাই। এটা আমাদের ইন্সটিংক্টের মধ্যে আছে। এটা আমি অর্জন করি না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: না। কোনো কিছু করার জন্য তো আপনার একটা প্রাথমিক জিনিস লাগবে যেটা দিয়ে আপনি ধরবেন। যেমন: মাছ ধরার জন্য ছাইটা তো লাগবে।
ময়ূখ চৌধুরী: কিন্তু আমার ভিতরে মনে করেন যে, আমি একটা বর্ণনা দিই- বাজারে গেলাম। যেখানে পান সুপারি বিক্রি করে সেখানে গেলাম। তার পাশে আরেকটা দোকান আছে, মুদি দোকান। সেখানে পাকা তেঁতুল বিক্রি করছে। উপরে আবার সয়াবিন তেল দিয়ে চকচকে করে রেখেছে। ওখান থেকে দাড়িগোঁফ বেরিয়েছে, শলা। একটা টোকাইমার্কা ছেলে গিয়ে আস্তে করে নখ দিয়ে এমনি করে… উমমম! তেঁতুল, তেলাপোকার মতন রঙ, পা-কা তেঁতুল! আপনার জিহ্বার তলা দিয়ে একটু ভিজা ভিজা লাগছে না এখন? কই, এখানে তেঁতুল কোথায়?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আইডিয়াটা পপ-আপ করছে মাথার মধ্যে।
ময়ূখ চৌধুরী: তেঁতুলটা খেলে আপনার যে রিয়েকশনটা হতো, সেটা কিন্তু এই বর্ণনার দ্বারা হয়ে যাচ্ছে। এরকম প্রতিটা কিছুর বর্ণনা যদি সেরকম গাঢ় এবং গভীর হয় তাহলে আপনার ইন্সটিংক্টের মাধ্যমে আপনার ইন্দ্রিয়কে নির্ভর করে, আছড় করে আপনাকে ভাবিত করবে। তখন আপনি রিয়েক্ট করবেন। এই যে এখন তেঁতুলের কথা বললাম আমার জিহ্বার তলা ভিজা। কই এখানে তেঁতুল আমরা খাইনি, দেখিওনি। শুধু বর্ণনা।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: বর্ণনাটা আমাদের ব্রেইনের মধ্যে একটা গ্রাফিক্যাল…
ময়ূখ চৌধুরী: এ যে আমাদের জিহ্বার মধ্যে ঐ ‌‘মেশিন’টা আছে এটা তেঁতুল, এটা রসগোল্লা বুঝার জন্য। তাহলে আমরা জিহ্বা, ত্বক, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা নিয়ে জন্মগ্রহণ করছি। কোনটা হাসনাহেনা, কোনটা গোলাপ ডিফারেন্সিয়েট যে আমরা করতে পারছি তা এই যন্ত্র দিয়ে। যেটা নিয়ে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি। ওই যন্ত্রগুলোকে ব্যবহার করে আমার যন্

No comments:

Post a Comment

Recent Post

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯

১. ‘ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ’ কবিতায় সালামের হাতে কেন অবিনাশী বর্ণমালা ঝরে ? ক. সংগ্রামী চেতনার কারণে     খ. দুঃখিনী মাতার অশ্রুজল দেখে গ. বরকত...

Most Popular Post