Ad-1

Saturday, September 7, 2024

রবীন্দ্রনাথের প্রতি অপবাদ দূর

রবীন্দ্রনাথ নিষ্ঠুর জমিদার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রজাদের সারাজীবন শোষণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ কখনোই এদেশের কৃষকদের, সাধারণ মানুষের কখনো উন্নতি চাননি।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছেন, 'মূর্খের দেশে আবার কিসের বিশ্ববিদ্যালয়'।  এমন কতো অপবাদ কি অবলীলায় চালানো হয় রবীন্দ্রনাথের নামে। কতো মিথ্যাচার শুনতে হয়।

অথচ শিলাইদহ, শাহজাদপুর বাদ দিলাম এক পতিসরেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারীতে যা করেছেন বাংলার ইতিহাসে কোন জমিদার তা করেনি। 

পারিবারিক সূত্রে পাওয়া জমিদারী দেখাশোনার জন্য ১৮৯১ সালে  প্রথম পতিসরে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জমিদারি ভাগ হওয়ায় নওগাঁর কালিগ্রাম পরগণার জমিদারি পেয়েছিলেন  রবীন্দ্রনাথ।

তৎকালীন সময়ে  কালিগ্রাম পরগণা ছিল নিচু এলাকা। এক ফসলি জমি। একটিমাত্র ধানের আবাদ হয়, তাও বন্যায় ষোলো আনা পাওয়া যায় না। অধিকাংশ প্রজাই দরিদ্র।

 একবেলা খেতেও পারত না। এসব বিষয়গুলো রবীন্দ্রনাথকে ভাবিয়ে তুলতো। মহাজনী সুদ থেকে প্রজাদের বাঁচাতে রবীন্দ্রনাথ স্বজনদের কাছ থকে টাকা ধার নিয়ে ১৯০৫ সাল থেকে প্রথম ‘কৃষি ব্যাংক’ চালু করেছিলেন।

মহাজনরা অখুশি হলেও গ্রামে-গ্রামে প্রজাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই ব্যবস্থা। কৃষকদের বাঁচাতে আরো টাকা প্রয়োজন।

নিজের নোবেল পুরস্কারের ১ লাখ ৮ হাজার টাকা কৃষি ব্যাংকে দিয়েছিলেন  রবীন্দ্রনাথ। তিনি এতোটাই নিষ্ঠুর জমিদার ছিলেন ঋণ আদায় করতে না পারায় অর্থ সংকটে পড়ে ব্যাংকটি।  এমতাবস্থায় ১৯৩৭ সালে জুডিশিয়াল বোর্ড গঠন করলে ঋণ ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়।  তখন প্রজাদের কাছে থাকা ঋণের সব অর্থই আটকে যায়। 

১৯১০ সালে  পতিসরের কাছারি বাড়ির একটি কক্ষে হোমিও দাতব্য চিকিত্সালয় স্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনার। কিন্তু হোমিও ওষুধ দিয়ে সব রোগের চিকিত্সা হতো না। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অঞ্চলে প্রথম আধুনিক চিকিত্সা সেবা শুরু করেন।

 পরে সার্টিফিকেটধারী চিকিত্সক নিয়োগ দিয়ে প্রজাদের চিকিত্সা সেবা দিতেন। তখন নার্সও নিয়োগ দেয়া হয়। তিন-চারটি বেড রাখা হয়েছিল। এই চিকিত্সাসেবা ১৯২০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।

এলাকার কৃষকদের বাঁচাতে ধর্মগোলা স্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ধর্মগোলা মানে শস্যভান্ডার। যে বছর আবাদ ভালো হতো সে বছর প্রজাদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্য নিয়ে রেখে দেয়া হতো ধর্মগোলায়। 

যখন আবাদ হতো না তখন সেই গোলা থেকে কৃষকদের মধ্যে দেয়া হতো। আবার আবাদ হলে সে শস্য আবার ধর্ম গোলায় জমা করতেন কৃষকেরা। 

 সে সময় কোনো মহাজনদের কাছ থেকে এক মণ খাদ্য নিলে দেড় গুণ বা দুই গুণ খাদ্য দিতে হতো মহাজনকে। এজন্য দরিদ্র প্রজাদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল এই ধর্মগোলা।

 হতদরিদ্র প্রজাদের গাভী পালনে প্রশিক্ষণ ও ধানচাষের বাইরে অন্য পেশায় আয় বাড়াতে তাঁতব্যবস্থা, অন্য ফসলের দিকে যেন মানুষ  আকৃষ্ট হয় সে ব্যবস্থাও করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। 

এ জন্য কয়েকজনকে নিয়ে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে্য শ্রীনিকতনেও। সেখানে তাঁদের কৃষি প্রশিক্ষণ দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছেন পতিসরে। এক ফসলি জমিতে অন্য ফসল চাষ করাতে জমির আইলে খেজুর গাছ, আমগাছ, পেঁপে চাষ শুরু করান তিনি। 

এ ছাড়াও বাস্তুভিটাতে ফলের গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করতেন। এসময়ে এলাকায় অপ্রচলিত ভুট্টা, আলুর চাষ শুরু করেন। 

প্রজাদের মহাজনদের সুদের বেড়াজাল থেকে বাঁচাতে ঋণ সালিশী সংস্থা কালিগ্রাম হিতৈষীসভা গঠন করেন রবীন্দ্রনাথ

সে সময় কালিগ্রাম কাছারিবাড়ি থেকে কালিগ্রাম পরগণায় জমিদারির কার্যক্রম পরিচালনা করা হত। কালিগ্রাম পরগণার আওতায় প্রায় ৬শ’ গ্রাম ছিল। 

এই ‘হিতৈষীসভা’ তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে কালিগ্রাম হিতৈষীসভা, ভান্ডারগ্রাম হিতৈষীসভা ও পতিসর হিতৈষীসভা। কাছারি বাড়ির আওতায় থাকা প্রতিটি গ্রাম থেকে একজন গ্রাম প্রধান ও কাছারি বাড়ির একজন ও জমিদারের প্রতিনিধি একজন করে পঞ্চায়েত গঠন করা হয়েছিলো। 

এই পঞ্চায়েতের কাজ ছিলো গ্রামের সাধারণ মানুষদের বিরোধ মিটিয়ে দেয়া, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, সেতু নির্মাণ করা, পাঠশালা নির্মাণ করা। ম্যালেরিয়া হওয়ায় গ্রামের জঙ্গল কেটে ফেলা ইত্যাদি। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, সেতু নির্মাণ, পাঠশালা নির্মাণ, গ্রামের জঙ্গল কেটে ফেলতে তো টাকা লাগবে। 

কিন্তু সে টাকা কোথা থেকে আসবে? তখন সিদ্ধান্ত হলো রবীন্দ্রনাথ অর্ধেক টাকা দিবেন, আর বাকি অর্ধেক টাকা হিতৈষীসভা  দিবে।

 এভাবে কয়েক বছরের মধ্যে তখন ১১ হাজার টাকা সংগ্রহ হয়েছিল। এরপর শুরু হয় রাস্তাঘাট নির্মাণ, পাঠশালা নির্মাণ।

 ৬শ’ গ্রামের মধ্যে প্রায় ২০০ টি গ্রামে পাঠশালা নির্মাণ করে পাঠদান শুরু হয়।  এই পাঠশালার মাস্টারদের বেতন ও দিতেন রবীন্দ্রনাথ।  একইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ   তিনটি মাইনর স্কুল চালু করেন। একটি পতিসরে, অপর দুটি রাতোয়াল ও ভান্ডারগ্রামে।

 নিজের প্রজাদের জন্যে চাষ ব্যবস্থায় উন্নয়ন ঘটানো জন্যে ১৯০৬ সালে  রবীন্দ্রনাথ নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও  শিরিষ চন্দ্র মজুমদারের ছেলে সন্তোষ চন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষির উপর পড়াশুনার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। অথচ তিনি চাইলেই ইঞ্জিনিয়ারিং বা অন্য কিছু পড়াতে পারতেন! 

 রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সন্তোষ চন্দ্র মজুমদার যখন কৃষির উপর পড়তে আমেরিকা গেলেন তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁদের চিঠিতে লিখেছিলেন, 

. ‘তোমরা দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজার অন্ন গ্রাসের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ। ফিরে এসে এই হতভাগ্যদের অন্ন গ্রাস কিছু পরিমাণেও যদি বাড়িয়ে দিতে পার তাহলে মনে সান্ত্বনা পাব। মনে রেখো, জমিদারের টাকা চাষির টাকা এবং এই চাষিরাই তোমাদের শিক্ষার ব্যয়ভার নিজেরা আধপেটা খেয়ে এবং না খেয়ে বহণ করছে। এদের ঋণ সম্পূর্ণ শোধ করবার দায় তোমাদের উপর রইল। নিজেদের সংসারিক উন্নতির চেয়েও এইটেই তোমাদের প্রথম কর্তব্য হবে।’

 ১৯০৯ সালে পড়াশোনা শেষে  দেশে ফিরে এলেন রথীন্দ্রনাথ ও সন্তোষ মজুমদার।  কলকাতায় বা পশ্চিমবঙ্গে না রেখে নিজের ছেলেকে  পতিসরে নিয়ে এলে রবীন্দ্রনাথ। তখন  রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলের লাঙ্গলে চাষ করে আধুনিক পদ্ধতি শিখিয়েছেন প্রজাদের।    আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য পতিসরে ৭টি বিদেশি কলের লাঙল এনেছিলেন  কলকাতা থেকে। সঙ্গে আনিয়ে ছিলেন বিদেশি ইঞ্জিনিয়ার।

আধুনিক চাষাবাদ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়, খামার ব্যবস্থাপনা, হস্ত ও কুটিরশিল্প, তাঁতশিল্প, রেশমশিল্পের বিকাশ ঘটানো ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য রবীন্দ্রনাথ পতিসরে যা করেছিলেন তাতে পতিসর কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় দারিদ্র শূন্য হয়ে গিয়েছিলো। 

পতিসরকে মডেল হিসেবে তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,  ‘তোমরা যে পার ‍এবং যেখানে পার এক-একটি গ্রামের ভার গ্রহণ করিয়া সেখানে গিয়া আশ্রয় লও। গ্রামগুলিকে ব্যবস্থাবদ্ধ করো। শিক্ষা দাও, কৃষিশিল্প ও গ্রামের ব্যবহার‍সামগ্রী সম্বন্ধে নূতন চেষ্টা প্রবর্তিত করো।'

রথীন্দ্রনাথ ঠাকু্র তাঁর পিতৃ স্মৃতি গ্রন্থে বাবা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি তুলে এনেছিলেন।  রবীন্দ্রনাথ সেই চিঠিতে ছেলেকে লিখেছিলেন, 

'পতিসরে পৌঁছে গ্রামবাসীদের অবস্থার উন্নতি দেখে মন পুলকিত হয়ে উঠলো। পতিসরের হাইস্কুলে ছাত্র আর ধরছে না। দেখলুম– নৌকার পর নৌকা নাবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ছেলের দল স্কুলের ঘাটে। এমনকি, আট-দশ মাইল দূরের গ্রাম থেকেও ছাত্র আসছে। পড়াশুনার ব্যবস্থা প্রথম শ্রেণীর কোন ইস্কুলের চেয়ে নিকৃষ্ট নয়। পাঠশালা, মাইনর স্কুল সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। হাসপাতাল ও ডিস্পেনসারিতে কাজ ভালো চলছে। যে সব জোলা আগে এক সময় গামছা বুনতো তাঁরা এখন ধুতি, শাড়ী, বিছানার চাদর বুনতে পারছে। কুমোরদেরও কাজের উন্নতি হয়েছে। গ্রামবাসীর আর্থিক দুরবস্থা আর নেই। শুধু চাষীরা অনুযোগ জানালো তাদেরকে চাষের জন্য আরও ট্রাক্টর এনে দেওয়ার জন্য।'

রবীন্দ্রনাথ ১৯১১ সালের উইলে নিজের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি দান করেছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথকে। এক চিঠিতে

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়কে  রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,  'জমিদারি সম্পত্তির আয় নিজের ভোগে না লাগাইয়া প্রজাদের হিতার্থে যাহাতে নিযুক্ত করেন রথীকে সে সম্বন্ধে বার-বার উপদেশ দিয়াছি। তদনুসারে এইরূপ মঙ্গল অনুষ্ঠানে সে যদি তাহার পৈত্রিক সম্পত্তি প্রসন্নচিত্তে উৎসর্গ করিতে পারে তবে আমার বহুকালের একান্ত ইচ্ছা পূর্ণ হয়..'

পতিসরের জমিদারী ছেড়ে দিলেও রবীন্দ্রনাথ পতিসরকে কিংবা পরিসরের মানুষ রবীন্দ্রনাথকে কখনোই ভুলতে পারেনি। 

 তাইতো  প্রজাদের প্রবল  অনুরোধে মৃত্যুর চার বছর আগে  ১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই শেষবারের মতো পতিসরে এসেছিলেন কথিত নিষ্ঠুর ও বর্বর জমিদার রবীন্দ্রনাথ। 

ছবি-  সাধারণ মানুষের কথা শুনছেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ।




No comments:

Post a Comment

Recent Post

"শাকেই এত লাড়া, ডাল হলে ভাঙত হাঁড়ি, ভাসত পাড়া-পাড়া।" এই কথা দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে?

এই প্রবাদটি বোঝাতে চায় যে ছোটোখাটো বিষয়ে যদি এত ঝামেলা বা উত্তেজনা হয়, তাহলে বড় কোনো বিষয়ে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। "শাকেই এত লাড়া&...

Most Popular Post