Ad-1

Thursday, September 12, 2019

বলাকা কবিতা ও তার সমালোচনা

বলাকা -
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হল–যেন খাপে-ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার;
দিনের ভাঁটার শেষে রাত্রির জোয়ার
এল তার ভেসে-আসা তারাফুল নিয়ে কালো জলে;
অন্ধকার গিরিতটতলে
দেওদার তরু সারে সারে;
মনে হল সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে,
বলিতে না পারে স্পষ্ট করি,
অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছেগুমরি।
সহসা শুনিনু সেই ক্ষণে
সন্ধ্যার গগনে
শব্দের বিদ্যুৎছটা শূন্যের প্রান্তরে
মুহূর্তে ছুটিয়া গেল দূর হতে দূরে দূরান্তরে।
হে হংস-বলাকা,
ঝঞ্ঝা-মদরসে মত্ত তোমাদের পাখা
রাশি রাশি আনন্দের অট্টহাসে
বিস্ময়ের জাগরণ তরঙ্গিয়া চলিল আকাশে।
ওই পক্ষধ্বনি,
শব্দময়ী অপ্সর-রমণী
গেল চলি স্তব্ধতার তপোভঙ্গ করি।
উঠিল শিহরি
গিরিশ্রেণী তিমির-মগন
শিহরিল দেওদার-বন।
মনে হল এ পাখার বাণী
দিল আনি
শুধু পলকের তরে
পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে
বেগের আবেগ।
পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ;
তরুশ্রেণী চাহে, পাখা মেলি
মাটির বন্ধন ফেলি
ওই শব্দরেখা ধরে চকিতে হইতে দিশাহারা,
আকাশের খুঁজিতে কিনারা।
এ সন্ধ্যার স্বপ্ন টুটে বেদনার ঢেউ উঠে জাগি
সুদূরের লাগি,
হে পাখা বিবাগী।
বাজিল ব্যাকুল বাণী নিখিলের প্রাণে–
“হেথা নয়, হেথা নয়, আর কোন্‌খানে।”
হে হংস-বলাকা,
আজ রাত্রে মোর কাছে খুলে দিলে স্তব্ধতার ঢাকা।
শুনিতেছি আমি এই নিঃশব্দের তলে
শূন্যে জলে স্থলে
অমনি পাখার শব্দ উদ্দাম চঞ্চল।
তৃণদল
মাটির আকাশ-’পরে ঝাপটিছে ডানা,
মাটির আঁধার-নীচে কে জানে ঠিকানা
মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা
লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা।
দেখিতেছি আমি আজি
এই গিরিরাজি,
এই বন, চলিয়াছে উন্মুক্ত ডানায়
দ্বীপ হতে দ্বীপান্তরে, অজানা হইতে অজানায়।
নক্ষত্রের পাখার স্পন্দনে
চমকিছে অন্ধকার আলোর ক্রন্দনে।
শুনিলাম মানবের কত বাণী দলে দলে
অলক্ষিত পথে উড়ে চলে
অস্পষ্ট অতীত হতে অস্ফষ্ট সুদূর যুগান্তরে!
শুনিলাম আপন অন্তরে
অসংখ্য পাখির সাথে
দিনেরাতে
এই বাসাছাড়া পাখি ধায় আলো-অন্ধকারে
কোন্‌ পার হতে কোন্‌ পারে।
ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্য নিখিলের পাখার এ গানে–
“হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্‌খানে।”

কবিতাটির ব্যাখ্যা ও সমালোচনা

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গতির উপাসক। তিনি ছিলেন নবপ্রবণ ও নবগতির জয়ঘোষক। কবি-মনের সেই গতির সুরই সুস্পষ্ট হয়ে ফুটেছে ‘বলাকা’ কাব্যে। বলাকার প্রতিটি কবিতায় কবি গতির জয়গান গেয়েছেন।
বীজ থেকে অঙ্কুরে, অঙ্কুর থেকে বৃক্ষে, বৃক্ষ থেকে ফুলে, ফুল থেকে ফলে, আবার ফল থেকে বীজে চলেছে প্রাণের যাত্রা। জীবন ও মৃত্যুর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই গতির লীলা বিরাজমান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই বলেছেন, “আমার ‘বলাকা’র কবিতাগুলোতেও সেই গতির কথাই বলেছি। গতির ছন্দেই বিশ্বের সৌন্দর্য। গতি নিয়েই সৃষ্টি। এই চরাচর সেই সৃষ্টি বা গতির প্রবাহ। কি অপূর্ব ছন্দে এ সৃষ্টির প্রবাহ চলছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়।”
বলাকা-কাব্য সৃষ্টির যুগে কবির অবস্থাও বিশেষ অনুধাবনযোগ্য। তিনি নিজেই বলেছেন, ইউরোপের দম্ভ ও লোভ যে সর্বজাতির কল্যাণ যাত্রার পথকে রুদ্ধ করে জগদ্দল পাথরের মতো সবার বুকে চেপে বসে থাকবে তা কখনও বিধাতার অভিপ্রায় হতে পারে না। এতে সারাজগতের অন্তরাÍা প্রপীড়িত।
নিপীড়িত জাতিদের যে মুক্তির প্রয়োজন সেই মুক্তি ইউরোপেও চাই। সবাইকে মুক্তি না দিলে তারও তো মুক্তি নেই। যে অকল্যাণ সে অন্যের ওপর চাপাতে চাইছে সেই অকল্যাণের চাপেই সে মরবে। তারই হাতের আগুনে তারই ঘর দগ্ধ হয়ে ছারখার হয়ে যাবে। কবিগুরু এসব কিছুই দেখতে চান না। ভাবীকালের সবারই মঙ্গল হোক, কল্যাণ হোক এই তো কবির কামনা। তাই কবি ভাবীকালের পক্ষ নিয়েছেন। প্রতিনিয়তই তিনি কল্যাণের জয়ঘোষণা করে চলেছেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, সৃষ্টিকর্তা তাকে (কবিকে) মৈত্রী ও কল্যাণবার্তা বহনের ভার দিয়েছেন। কবি তাই সেই বার্তাকে বহন করে নিয়ে চলেছে কবিতার ছন্দে ছন্দে। আর চলার সেই ছন্দেই ‘বলাকা’র সৃষ্টি। গতির সৃষ্টি।
কাশ্মীরের এক সন্ধ্যাকালে ঝিলাম নদীতে বসে যখন কবি ভাবনায় বিভোর সেই ক্ষণে একঝাঁক বলাকা উড়ে যেতে দেখলেন কবিগুরু। চলার গতির একটা বেগ যেন কবির নয়নের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সেই যাত্রার ধ্বনি শুনে সমগ্র বিশ্বের সর্বত্র যেন জেগেছে একটা যাত্রার বেগ। সবখানেই এক ব্যাকুলতা,
‘হেথা নয়, অন্য কোথা,
অন্য কোনখানে।’-বলাকা যেন কবি প্রাণের গতির বাহন।
‘বলাকা’ তাই সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। পূর্ববর্তী কাব্যে কবি প্রকৃতি, মানব ও জীবের সঙ্গে আÍস্থ হওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু তার পরে এসেই তার সুর পরিবর্তিত হয়ে গেল। আর এ নতুন সুরই ‘বলাকা’র সুর। গতির নিত্য স্রোত ও তার ছন্দে পরিবর্তন এ কাব্যে প্রধানভাবে লক্ষণীয়। এ কাব্য পরিচয়দৃষ্ট হয় যে, জগতে কোনো কিছুই স্থির হয়ে নেই। সব কিছুই বন্ধন থেকে মুক্তির পানে ধাবমান। এ নিরবচ্ছিন্ন চলাতেই তার আনন্দ। আর এ চলার যেন কোনো বিরাম নেই। শেষ নেই। কেন না, এ গতি প্রবাহের গতি যেদিন রুদ্ধ বা বন্ধ হয়ে যাবে সেদিনই জড়ত্ব ও পঙ্গুতায় মৃত্য এসে উপস্থিত হবে।
গতির ছন্দ রূপ পেল ‘বলাকা’ কবিতায়। কাশ্মীরের ঝিলাম নদীর আকাশে তখন সন্ধ্যা। ঝিলামের জল অন্ধকার। প্রকৃতি নিথর। কবি লিখেছেন,
‘সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলামের
স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হল, যেন
খাঁপে-ঢাকা বাঁকা তলোয়ার;
সহসা শুনিনু সেই ক্ষণে
সন্ধ্যার গগনে
শব্দের বিদ্যুৎছটা শূন্যের প্রান্তরে
মুহূর্তে ছুটিয়া গেল দূর হতে
দূরান্তরে।’
প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে একঝাঁক বুনো হাঁস পাখা মেলে উড়ে গেল ঝিলাম নদীর বুকে, বোটে উপবিষ্ট কবির মাথার ওপর দিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে কোন্ দূর থেকে দূরান্তরে উধাও হয়ে চলে গেল। কবির লেখনী হতে বের হয়ে এলো,
‘হে হংস বলাকা
ঝঞ্ঝা মদরসে মত্ত
তোমাদের পাখা
...
গিরি শ্রেণী তিমির মগন
শিহরিল দেওদার বন।’
মুহূর্তের নীরবতা ভেঙে একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি কারল হংসের ডানা ঝাপটা। সুপ্তমগ্ন আকাশ আচমকা আঘাত পেয়ে জেগে উঠল।
স্তব্ধতার মৌনতা ভেঙে গেল। রোমাঞ্চিত মনে প্রশ্ন জাগিল, একী হল! তিনি কবিতায় লিখলেন,
‘মনে হল এই পাখার বাণী
দিল আনি
শুধু পলকের তরে
পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে
বেগের আবেগ।
...
বাজিল ব্যাকুল বাণী লিখিলেন প্রাণে
হেথা নয়, হেথা নয়,
আর কোনখানে।’
সন্ধ্যার নীরবতায় এই পাখার বাণী যেন এক মুহূর্তে পুলকিত বেগের আবেগ জাগিয়ে দিল। মন উš§না হল। চিত্তে জাগল চলার বাসনা। আকাশে সুদূরে হারিয়ে যাওয়ার জন্য অন্তর আকুল হল। উদাসী পাখির পাখায় শব্দে যেন বিবাগী সুর প্রতিধ্বনিত হল। সেই উদাসী পাখার ব্যথিত বাণীতে পৃথিবীর প্রাণেও জাগল এক আকুলতা। অজানা এক ব্যাকুলতা। সেই বাণী যেন মুখর হয়ে উঠল ব্যথা আর বেদনার সুরে।
‘হেথা নয়, হেথা নয়,
আর কোনখানে।’
কবির লেখনী এগিয়ে চলল। তিনি লিখলেন,
‘হে হংস বলাকা,
আজ রাত্রে মোর কাছে
খুলে দিলে স্তব্ধতার ঢাকা।
ধ্বনিয়া উঠেছে শূন্য
লিখিলেন পাখার এ গানে
হেথা নয়, অন্য কোথা,
অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।’
কবি উপলব্ধি করলেন তার মনের তলের বেগ ও বাণী। হংস বলাকা তার গতি দিয়ে কবির অন্তরের আবরণের দ্বার খুলে দিল। নিশ্চল হয়ে উঠল সচল। পেল গতি। সবকিছুই যেন ব্যাকুল হয়ে সন্ধ্যাকাশের উড়ে যাওয়া বলাকার মতো উড়ে যেতে চাইছে অজ্ঞাত পানে। মানুষের ভাবনা, আশা-আকাক্সক্ষাও উড়ে চলেছে। ভবিষ্যতের গর্ভে কি আছে জানা নেই তবু আশা-আকাক্সক্ষার মোহে নিরুদ্দেশের পানে ছুটে চলেছে। কোথায় সব চলেছে কে জানে?
কবি বসে বসে নিখিলের সব পাখার ঝাপটায় একই বাণীর সুর ধ্বনিত হতে শুনছেন। যেন সব কিছুই সুর তুলেছে,
‘হেথা নয়, হেথা নয়,
আর কোনখানে।’
কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে, হেথা নয়তো কোথায়?
‘বলাকা’ কাব্যে তাই যে সুর বেজে উঠেছে সে সুর হল গতির। গতিবাদই হল বলাকা’র মর্মকথা। বলাকার বিমানগতি এবং তার পাখার শব্দ কবির অন্তরে অদ্ভুত কল্পনা জাগিয়েছে। সে কল্পনা গতি বা যাত্রার কল্পনা। প্রকৃতির একটা উপযুক্ত পরিবেশে কবির গতি-অনুভূতি বিস্ময়কর সমগ্রতা লাভ করেছে। এ অনুভূতি কবির একান্ত নিজস্ব। এ অনুভূতির গতির সঙ্গে একাÍ কবিমানসের শ্রেষ্ঠতম মুহূর্তের বহিঃপ্রকাশ।
‘বলাকা’ কবিতার বিভিন্ন পঙ্ক্তিতে বিশ্বের গতি-চাঞ্চল্যের সুর এত অনায়াসে মিলিত হয়ে পড়েছে যে, কি উপায়ে কবি একটি থেকে অপরটিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন তা বোঝার অবকাশ থাকে না। ছন্দে, ভঙ্গিতে, অলংকারে এবং প্রথম থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত উৎসারিত তীব্র আবেগে কবিতাটি কবির আÍলীনতার শ্রেষ্ঠ পরিচায়ক হয়েছে। কবিতাটির শেষ অংশ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, কবি শুধু নৈর্ব্যক্তিকভাবে গতিস্পন্দিত বিশ্বকে দেখেননি, বরং সেই সঙ্গে তিনি আÍদর্শনের ইচ্ছুকও।

[কৃতজ্ঞতা স্বীকার;মোবারক হোসেন খান,বিশ্লেষণ ও সমালোচনা ইত্তেফাক পত্রিকা থেকে সংগৃহীত]

No comments:

Post a Comment

Recent Post

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯

১. ‘ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ’ কবিতায় সালামের হাতে কেন অবিনাশী বর্ণমালা ঝরে ? ক. সংগ্রামী চেতনার কারণে     খ. দুঃখিনী মাতার অশ্রুজল দেখে গ. বরকত...

Most Popular Post