Ad-1

Tuesday, October 1, 2019

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-সময়ের চেয়ে আধুনিক বাঙ্গালি!

‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ’

অর্থাৎ, স্বামী নিখোঁজ বা মৃত্যুবরণ করলে কিংবা নপুংসক বা পতিত হলে স্ত্রী আবার বিয়ে করতে পারেন।

বিদ্যাসাগর সংস্কৃত এই বাক্যটি পেয়েই বলে উঠেছিলেন, ‘পেয়েছি পেয়েছি’। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যিনি ঊনিশ শতকের সমাজ সংস্কারক, যিনি নিজ সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন – তার অন্যতম এক সংস্কারকাজ ছিল বিধবা বিবাহ প্রচলনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।

সেসময় তিনি রাত দিন একাকার করে শাস্ত্র পড়তেন। বীরসিংহ গ্রামে একদিন বিদ্যাসাগরের মা ভগবতীদেবী প্রতিবেশী এক কিশোরী কন্যার অকালে বিধবা হয়ে যাওয়া দেখে, আকুল হয়ে পুত্রের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিধবাদের বাঁচার কি কোনো উপায় আছে?

বিদ্যসাগর জানান, বিধবাদের বিয়ে শাস্ত্র সিদ্ধ। তিনি এই বিষয়ে লিখবেন কিন্তু সমাজে বেশ একটা হট্টগোল হতে পারে এনিয়ে। কারণ, বিধবারা আবার বিয়ে করবে, কোনো পুরুষ বিধবা নারীকে বিয়ে করবে- একথা সেইসময়কার সমাজে কেউ ভাবা দূরে থাক, কল্পনাতেও বোধহয় আনতে পারত না।

বিধবা বিবাহ প্রচলনের প্রতি বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত উপলব্ধি জন্মায় সম্ভবত আরো আগে। ছোট বেলায় গ্রামে রাইমনি নামে এক সঙ্গী ছিল তার। রাইমনির বিয়ে হয়ে গেল খুব অল্প বয়সেই৷ স্বামীর বাড়ি চলে যায় সে। কিছু বছর বাদে রাইমনি বিধবা হয়ে গ্রামে ফিরে আসে একমাত্র ছেলে গোপালকে সাথে নিয়ে।

বিদ্যাসাগরও একদিন গ্রামে ফিরে দেখলেন রাইমনি ফিরে এসেছে কিন্তু তার সারা মুখে যেন স্থায়ী বিষণ্ণতার ছাপ। সেদিন একাদশী, রাইমনি উপবাস করছিল। তার দিকে যেন তাকানোই যায় না। কি যে কষ্ট চোখে মুখে…বিদ্যাসাগর তখন উপলব্ধি করলেন, হিন্দু বিধবা নারীদের বৈধব্য থেকে মুক্তি দিতে হলে, পুনর্বিবাহ দেয়া ছাড়া গতি নেই।

বিদ্যাসাগর সেসব দিনে রাত দিন পড়তেন। শাস্ত্র পড়তে গিয়েই তিনি সেই সংস্কৃত বাক্যটি খুঁজে পেয়েছিলেন। সেটা ১৮৫৩ সালের কথা।

বিদ্যাসাগর

পরের বছর, সময়টা যখন ১৮৫৪ সাল, ডিসেম্বর মাসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে “সমাজোন্নতি বিধায়িনী সুহৃদ সমিতি” নামক সভা হয়। এই সভায় হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ, বহুবিবাহ রোধ ও বাল্যবিবাহ বর্জন নিয়ে কিশোরীচাঁদ মিত্রের প্রস্তাব উঠে। অক্ষয়কুমার দত্ত প্রস্তাব সমর্থন করেন। প্রস্তাবের প্রতিলিপি পাঠানো হয় বৃটিশ লিগ্যাল কাউন্সিলে।

১৮৫৫ সালে বের হয় বিদ্যাসাগরের বইটি। বিধবা বিবাহ নিয়ে লেখা তার প্রথম বইয়ের দুই হাজার কপি অল্পসময়ে শেষ হয়ে গেল। এই বই নিয়ে বেশ আলোড়ন তৈরি হয়। সংস্কারবিরুদ্ধ সমাজ থেকে প্রতিবাদ আসে। সমালোচনা আসে। বিদ্যাসাগরও পালটা জবাব চালিয়ে যেতে থাকেন।

সেবছরই অক্টোবরে ৯৮৬ জনের সই নিয়ে বিদ্যাসাগর সরকারের কাছে বিধবা বিবাহ প্রচলনের দাবি তুলেন। সমাজ যেন দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও বিদ্যাসাগরের বিপক্ষে ছিলেন তখন। সবদিক থেকে সমালোচনার তীর ধেয়ে আসছিল বিদ্যাসাগরের দিকে।

কিন্তু এই আন্দোলনও থেমে ছিল না। ১৮৫৬ সালে বর্ধমান থেকেও বিধবা বিবাহের সমর্থকদের আবেদন গেল সরকারের কাছে। বর্ধমানের রাজা মহতাব সিং বিদ্যাসাগরের পক্ষে সই করলেন। দীনবন্ধু মিত্র, প্যারিচাঁদ মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রমুখও বিদ্যাসাগরের পক্ষে প্রস্তাব সমর্থন দিয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেন।

কিন্তু, প্রতিবাদে বিরোধী পক্ষের সই পড়লো আরো বেশি। সতর্ক করা হলো এই বলে, বিধবা বিবাহ চালু হলে ভারতে ধর্মদ্রোহ হবে।
কিন্তু, তারপরেও ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই সরকার বিধবা বিবাহ অনুমোদন দিয়ে আইন পাশ করলো! লর্ড ডালহৌসি আইন প্রণয়ন করে বিধবা বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেন।

এবার দেখা দিলো, নতুন ফ্যাঁকড়া। বিধবাদের বিয়ে দিতে কেউ চাচ্ছে না, বিধবাদের বিয়ে করার মতো আগ্রহী কাউকেও দেখা যাচ্ছে না।

বিধবা বিবাহ, বিদ্যাসাগর
এগিয়ে এলেন বিদ্যাসাগরই। তিনি দৃঢ় ছিলেন, বলেছিলেন, “বিধবার বিয়ে হবে, আমিই দিব।”
*
১৮৫৬ সালেরই ৭ ডিসেম্বর। কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটের রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যয়ের বাড়িতে নিমন্ত্রিত ৮০০ জন মানুষ। এলাহী কান্ড একেবারে। বিধবা বিবাহ হবে। পাত্র সংস্কৃত কলেজের এসিস্টেন্ট সেক্রেটারি, তারপর মুর্শিদাবাদের জজ। পাত্রী দশ বছরের বিধবা মেয়ে যার বিয়ে হয়েছিল চার বছর বয়সে! বিদ্যাসাগর নিজের অর্থ খরচ করে জমকালো আয়োজন করে প্রথম বিধবা বিবাহ দেন।

এরপর বিধবা বিবাহ দেয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরকেই যেন সমাজ সব ভার দিয়ে দিয়েছে। আর কেউ এগিয়ে না এলেও বিধবা বিবাহ দেয়ার ক্ষেত্রে পাওয়া যায় বিদ্যাসাগরকে। তিনি নিজে ঋণে জর্জরিত হন। কিন্তু বিধবাদের বিয়ে দিতে কখনো পিছু হটেননা। ষাটজন বিধবার বিবাহ একাই দিয়েছিলেন তিনি।

এমনকি অনেকের মতের৷ বিরুদ্ধে গিয়ে নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রকেও বিয়ে দেন বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর সাথে। ১৮৭০ সালের কথা। এই বিয়ে বিদ্যাসাগরের স্ত্রী, মা কেউই মানতে চাননি। কিন্তু, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মুখে যা বলতেন ঠিক সেটাই করে দেখাতেন। যা অন্যের জন্যেও সমান, তার থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখতেন না। তাই নিজের পুত্রকেও বিধবা নারীর সাথে বিবাহ দিতে তার একটুও হীনমন্যতা জাগেনি। এমনই মানুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর।
*
তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রেও সংস্কার আনেন নিজ উদ্যোগে। একটা মানুষ তার সমস্ত সম্পত্তি বন্ধক রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতে পারে, এমন ক্ষ্যাপাটে লোকের কথা এই যুগেও ভাবা যায় না। কিন্তু, একজন বিদ্যাসাগর ছিলেন যিনি সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষ। তিনি৷ নিজের সমস্ত সম্পত্তি বন্ধক রেখে শংকর ঘোষ লেনে মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউট তৈরি করেছিলেন, যা প্রথম বেসরকারি বাংলা কলেজ এবং একই সাথে প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ কলেজও বটে!

তিনি হিন্দুশাস্ত্রবিদ হলেও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা তার স্বপ্ন ছিল। সংস্কৃত কলেজে থাকাকালীন সময়ে ওই কলেজের দ্বার তিনি উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন শুদ্রদের জন্যে, যারা নিচুজাত বলে সেই কলেজে ঢোকার অনুমতি পেতো না। তিনি চেয়েছিলেন মাতৃভাষায় শিখবে, শিক্ষিত হবে বাঙ্গালি। তাই, বাংলা বর্ণমালাকে সংস্কৃত ব্যাকরণের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা ভাবেন তিনি। তাই তিনি লিখেন বর্ণপরিচয় নামক গ্রন্থ। যে গ্রন্থের লিপিসংস্কার পরবর্তীতে বাংলা লিপির আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়।
*
সাহিত্যকেও তিনি সমৃদ্ধ করেন, সাহিত্যেও তিনি সংস্কার আনেন। মধ্যযুগীয় রীতি থেকে বেরিয়ে বাংলাকে আধুনিক করতে তার যত প্র‍য়াস। তিনি বাংলাতে সহজ ও আধুনিক ভাষারীতি চর্চা করেন। সহজবোধ্য গদ্যে তার লেখাগুলো।

তিনি পাঠ্যপুস্তকের অভাব দূর করার জন্য লিখেছেন বর্ণ পরিচয়, বোধোদয়, কথামালা, আখ্যানমঞ্জরী, বেতাল পঞ্চবিংশতি ইত্যাদি বই। আবার গদ্যে শৃঙ্খলা, বিন্যাস ও সাহিত্যের বাহন করে তুলবার জন্য লেখেন শকুন্তলা, সীতার বনবাস, মহাভারত, ভ্রান্তিবিলাস প্রভৃতি বই।

বর্ণপরিচয়

বাংলায় যতি চিহ্ন বা বিরাম চিহ্নের ব্যবহার প্রথম শুরু করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত বিদ্যাসাগর রচিত গ্রন্থ ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’তে তিনি প্রথম যতিচিহ্নের ব্যবহার শুরু করেন। এর আগে বাংলায় যতিচিহ্নের প্রচলন ছিল না।

এই চিহ্নের ব্যবহারের ফলে ভাষা লিখন এবং বোঝার ক্ষেত্রে অনেক সহজ হয়। বাংলাকে আরেকটু এগিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে এটা ছিল অনন্য সংযোজন।
*
রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে খুব বড় মানুষ বলে কদর করতেন। তিনি বলেন, “তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা। বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন।”

রবীন্দ্রনাথ এও লিখেছিলেন যে, “আমাদের এই অবমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল, আমরা বলিতে পারি না।”

অর্থাৎ, ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এই মাপের একজন মানুষের জন্ম বঙ্গদেশে হয়েছে এটা বেশ বিস্ময়কর। জীবদ্দশায় তিনি প্রতিকূলতা স্বত্তেও, সমাজের বিরুদ্ধেও গিয়েও যে সংস্কার করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, এমন সাহস বিরল।

আত্না বড় না হলে, বড় মনের মানুষ না হলে এতো বেশি স্বচ্ছতা আর স্পষ্টতা কারো মধ্যে থাকে না, যা ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মধ্যে। তাই বলি, তিনি এমন এক সময়ের প্রতিনিধি, যখন তার সমাজ প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু তিনি একাই সমাজকে প্রস্তুত করে তুলেছেন, সমাজের গতিপথ বদলে দিয়েছেন, ভাষাকে পূর্ণতা দিয়েছেন। তিনি তাই একজন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মহাপুরুষ!
সংগৃহীত : অনলাইন থেকে সংগৃহীত।

No comments:

Post a Comment

Recent Post

সুভা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর   জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ১. সুভার বাবার নাম কি? ২. সুভা কোথায় বসে থাকত? ৩. সুভা জলকুমারী হলে কী করত? ৪. সুভার গ্রামের নাম কী? ৫...

Most Popular Post