আরো কিছুদিন যদি বাবা ডাকতে পারতাম....
অনেকদিন আগে, প্রায় কমপক্ষে দশ বছর আগে, ডেল কার্নেগীর " দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন "-পড়েছিলাম।যেখানে পড়েছিলাম, কোন এক দুর্যোগের কারণে এক ব্যক্তি তার স্ত্রীসহ দুটো ছেলে মেয়েকে হারায়।তার ছোট ছেলেটাই একমাত্র জীবিত ছিল।তো লোকটা খুব বিমর্ষ, হতাশ এবং খুব যন্ত্রণায় একাকি দিন কাটাচ্ছিল।হঠাৎ তার ছেলেটা বাহানা ধরল তাকে একটা কাগজের নৌকা বানিয়ে দিতে।কিন্তু লোকটা তো কাগজের নৌকা বানাতে পারে না।আর ছেলেটাও ছিল নাছোড়বান্দা।তাই সে ছেলেটাকে কাগজের নৌকা বানিয়ে দিতে চেষ্টা করল।কিন্তু আধা ঘণ্টা চেষ্টা করেও সে নৌকা বানাতে পারলনা।কিন্তু এ আধা ঘণ্টা সময় পরে সে একটা বিষয় উপলব্ধি করল যে,সে যখন কাগজের নৌকা বানানোর কাজে ব্যস্ত ছিল তখন তার স্ত্রী ও সন্তান হারানোর বেদনাটা একটু কমই মনে হয়েছিল।সে বুঝল, কাজই আমাকে এ একাকীত্ব আর তীব্র বেদনা থেকে মুক্তি দিতে পারে।তাই সে কাজে লেগে যাওয়ার মাধ্যমে কিছুটা বেদনা লাগব করার চেষ্টা করল।(ঘটনাটা হুবহু মনে নেই, তবে ভাবটা এরকমই)
কয়েকদিন আগেই বাবা না ফেরার দেশে চলে গেছেন।সারাদিন চেষ্টা করি কর্মের মধ্যে ডুবে থেকে বাবাকে কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে, কিন্তু পারি না।গাড়ীতে চড়তে চড়তে ট্রাফিক জ্যামে গাড়ি কোন জায়গায় থেমে থাকলে বাবা তোমার কথা মনে পড়ে যায়,কর্মের ফাঁকে একাকী বসে থাকলে, কিংবা একাকী রাস্তায় চলতে চলতে বাবার কথা মনে পড়ে যায়।আর সবচেয়ে বেদনাটা বাজতে থাকে তখনই,যখন আমি রাস্তায়, গাড়ীতে কিংবা জীবন চলার পথে চুল, দাঁড়ি পেকে যাওয়া কিছুটা সবল সতেজ সত্তোরোর্ধ কোন বৃদ্ধ মানুষকে দেখলেই সঙ্গে সঙ্গেই বাবার কথা মনে পড়ে যায়।আর মনে মনে বলি, বাবা,তুমি আর কয়েকটা বছর বেশি বেঁচে থাকতে পারনি?তোমাকে আর কিছুদিন বাবা ডাকতে পারলেই যেন বাবা ডাকার প্রকৃত স্বাদ এবং তৃপ্তি মিঠাতে পারতাম। সংসারের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, স্বচ্ছলতার মধ্যে বাবা ডাকার স্বাদ কী রকম তা মিটানোর আগেই যেন তুমি চলে গেলে।
তোমাকে বাবা বলে ডেকেছি,যখন সংসারে সবসময় অভাবটা লেগেই থাকত তখন।তুমি সারাজীবন আমাদের জন্য ত্যাগ,বিসর্জন, কষ্ট করে গেলে। সংসারে দুটো পয়সা বাঁচানোর জন্য কত কষ্ট তুমি নিজেই করেছ।আর নিজের কাঁধে আধুনগর বাজার থেকে লাকড়ির বোঝা নিয়ে এসে আমাদের ফোনে বলতে রিকসায় করে নিয়ে এসেছ।এমনকি লাকড়ির বোঝা কাঁধে আছে এমন সময় বড় ভাই ফোন করলে তুমি বলেছ," হ্যাঁ বাবা,লাকড়ি রিকসায় করে নিয়ে যাচ্ছি।"
নিজে গরু দিয়ে সারাজীবন চাষাবাদ করেছ।অথচ তুমি কখনো আমাকে চাষ করার জন্য লাঙ্গল ধরতে দাওনি।তাই চাষার ছেলে হয়েও এই হতভাগা এখনও জমি চাষ করতে জানে না।চাষ করতে গিয়ে সব কাজ নিজে করতে পারতেনা বলে ছোট ছোট কাজগুলো আমাদের দিয়ে করাতেন।এরপরও কখনো শখ করে কোদাল দিয়ে মাটি কাটতে গেলেই কিংবা লাঙ্গল ধরলেই তুমি বলতে,ওগুলো তুমি পারবে না।তোমার গা ব্যাথা ও কোমরে ব্যাথা করবে। আর এটা বলে কোদালটা কেড়ে নিতে।
ধানের বড়ো বড়ো বোঝাগুলো তুমি বহন করতে আর আমাদের দিতে ছোট ছোট বোঝাগুলো।একবার মাথায় ধানের বোঝা তুমি তুলে দিয়েছিলে।কিছুদুর যেতে না যেতেই আমার গাড় ব্যাথা করছিল বলে পুরো ধানের বোঝা ফেলে দিয়েছিলাম ডুবাতে। তাতে তুমি একটুও বকা দাওনি বলে একটু স্বস্তি পেয়েছিলাম।কিন্তু এখন তা মনে পড়লে অবাক হই।
পড়ালেখা শেষ করে একটা ছোটখাট চাকরি পাই। বড়োভাই মুটামোটি স্বচ্ছল হচ্ছিল।বড় ভাই বাবাকে অনুরোধ করেছিল, বাবা, তুমি আর চাষাবাদ করো না।তোমার আর চাষাবাদ করার আর দরকার নেই।
একথা তুমি আমার সামনে কতবারই না বলেছ।আর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বারবার একটা কথাই প্রত্যাশা করেছ।আমিও যেন বড় ভাইয়ের মতো তোমাকে আর চাষ না করতে বলি।কিন্তু ছোটখাট চাকরি,কম মাইনের বেতন পাই বলে বাবা তোমাকে তা বলতে আমি সাহস করতে পারিনি।আর তুমি চাষাবাদও ছাড়নি।
কিন্তু যখন আমি একটু স্বচ্ছল হচ্ছিলাম। একদিন বাবাকে বলছিলাম, বাবা, তুমি আর চাষাবাদ করো না।তোমাকে আর চাষ করতে হবে না।বাড়ির যেটুকু জমি আছে সেটুকু মানুষ দিয়ে করাবে। লাঙ্গল তো দূরের কথা কোদালও ধরবে না।সেদিন তুমি কত খুশি হয়েছিলে,সে অনুভূতি প্রকাশে আমি অনেকটা সক্ষম নয়।আর তুমি সে বছর চাষাবাদ ছেড়েও দিলে।আর মানুষকে খুশি হয়ে বলতে লাগছিলে, আমার ছেলেরা আমাকে চাষ করতে নিষেধ করে দিয়েছে,আমার ছেলেরা আমাকে চাষ করতে নিষেধ করে দিয়েছে।।
আমি একটু হিসেবি ছিলাম।বাবা যখন আমার কাছে টাকা চাইতেন, আমি হিসেব নিতাম আর প্রশ্ন করতাম এত টাকা কেন লাগবে? কী কারণে? ওখানে অতটাকা লাগে নাকি? এতটাকা দিলে হবে না?তারপর বলতাম, এতটাকা পাঠাব আমি এর বেশি পাঠাব না।তখন তুমি বলতে ঠিক আছে, তুমি যা পার তা পাঠাও, বাকিটা আমি ব্যাবস্থা করে নিব।আর বড় ভাই ছিল আমার ব্যতিক্রম, কখনো জিজ্ঞেস করতো না, এতটাকা কেন লাগবে?
তাই তুমি ভেবেছিলে আমি তোমার জন্য কিছুই করবো না।কিন্তু শেষে তোমার জন্য আমার চিকিৎসা খরচের পরিমাণ দেখে বলছিলে,বাবা আমার জন্য এতটাকা কেন খরচ করতেছ? আমি তো আর বেশিদিন বাঁচবনা।আমি তো তোকে নি:স্ব করে দিচ্ছি। তখন তোমাকে বলছিলাম,বাবা আমার জীবনের সমস্ত উপার্জন দিয়ে যদি তোমাকে আমি দুটোমাস বেশি বাঁচিয়ে রাখতে পারি এবং দুটোমাস বেশি বাবা বলে ডাকতে পারি তাতেই আমার জীবন আর সমস্ত উপার্জন সার্থক হবে।এরপর তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম।
একটাসময় পর তোমার রোগটা আরও বেড়ে যায়।একসময় যে মানুষটা দিনে এক পোয়া বা আধা কেজি চালের ভাত খেত সে মানুষটা এখন সারাদিনে দুমোটো ভাতও খেতে পারে না। তারপর ডাক্তার অনুরোধ করল পাখির মতো করে হলেও যেন দুটো দুটো করে সারাদিন ভাত খেতে।কিন্তু সেটুকুও তুমি খেতে পারছিলে না। তখন আমি তোমাকে বলেছিলাম,বাবা, তুমি দুটো দুটো হলেও খাওয়ার চেষ্টা করিও।তুমি না খেলে তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর আমি, আমরা বাবা বলে কাকে ডাকব? বাবা।তোমার খেতে ইচ্ছে না হলে আমার ও আমাদের কথা স্মরণ করবে। তারপর তুমি খাওয়ার চেষ্টা করবে।একথা মোবাইলে বলার পর তোমার চোখে পানি এসেছিল কিনা জানি না? কিন্তু আমি কান্না ধরে রাখতে পারিনি বাবা।কারণ, বাবাকে এভাতে খেতে অনুরোধ করা অনেকটা বাবাকে বেঁচে থাকার জন্য আরো কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কিছু না।তারপর আমার এ কথা শুনে তুমি হাজারো চেষ্টা করতে দুটো ভাত খাওয়ার জন্য।আর আমি ফোন করে জিজ্ঞেস করলে তুমি বলতে, হ্যাঁ বাবা খেয়েছি।অনেক কষ্টে তোদের কথা মনে করে করে দুটো খেয়েছি।খেতে পারছিনা এরপরও তোদের জন্যই খেয়েছি।
শেষের দিকে মাকে নাকি তুমি বলেছ,,,,,,যে ছেলে আমার প্রত্যেকটি টাকার হিসেব নিতে চাইতো, এ ছেলে আমার জন্য ও আমাকে একটু বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং একটু সুস্থ রাখার জন্য এত্তকিছু করবে তা আমি কখনো কল্পনাও করিনি।তখন মনে মনে বলি,বাবা তুমি পড়া লেখা না করার কারণে যেমন পৃথিবীতে পাঁচটি মহাসাগর আছে তা জান না।সেই সঙ্গে তোমার ছেলের বুকেও যে তোমার জন্য আরেকটা আলাদা মহাসাগর আছে তাও তুমি জানতে না,বাবা।
অবশেষে তুমি চলে যাওয়ার কয়েকদিন আগের ঘটনা। তুমি বিছানায় শুয়ে আছ,আর আমি তোমার পাশে, হাতে হাতে তোমার মুষ্টা ধরে বসে আছি। হঠাৎ তুমি আমার দিকে তাকিয়ে শুয়ার মধ্যেই দুটো হাত প্রসারিত করে আমাকে তোমার বুকে একটু জড়িয়ে ধরতে কাছে ডাকলে। আর আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরলে তুমি কান্না বিজড়িত কণ্ঠে আমাকে বললে,"অবা আইতো আর ন পারীর" (বাবা আমি তো আর পারছি না)।তখন দুজনেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলাম।কারো মুখে কোন কথা নেই,ভাষা নেই,চারপাশে নিস্তব্ধতা। আছে শুধু নিস্তব্ধতার মধ্যে দুজনের বুকফাঁটা অঝর নিস্তব্ধ কান্না।
(বাবা,আল্লাহ তোমাকে জান্নাতের মেহমান বানিয়ে নিক.........)।
লেখক: জহির উদ্দীন
বি.এ(অনার্স),এম.এ (বাংলা),চ.বি।
বাংলা শিক্ষক,
বিএএফ শাহীন কলেজ চট্টগ্রাম।[০৮/০৮/২০১৬]
Ad-1
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Recent Post
মানুষের মূল্য কোথায়?
১. মানুষের মূল্য কোথায় ? চরিত্র , মনুষ্যত্ব , জ্ঞান ও কর্মে । বস্তুত চরিত্রবলেই মানুষের জীবনে যা কিছু শ্রেষ্ঠ ত...
Most Popular Post
-
বাংলা ছন্দ ছন্দ: কাব্যের রসঘন ও শ্রুতিমধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল ধ্বনিবিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তাকে ছন্দ বলে। (বাঙলা ছন্দ : জীবেন্দ...
-
অলঙ্কার এর সংজ্ঞাঃ অলঙ্কার কথাটি এসেছে সংস্কৃত 'অলম' শব্দ থেকে।অলম শব্দের অর্থ ভূষণ।ভূষণ অর্থ সজ্জা,গহনা ইত্যাদি। তাই আভিধানিক অর্থে...
-
উত্তর: তৎসম শব্দে মূর্ধন্য-ণ এর ব্যবহারের নিয়মকে ণ-ত্ব বিধান বলে।নিম্নে এর পাঁচটি নিয়ম বর্ণনা দেওয়া হলো... ১. ঋ,র,ষ এরপর মূর্ধন্য-ণ হয়। ...
-
নৌকাডুবি (১৯০৬) চরিত্র ও তথ্য সমূহ ১. রমেশঃকলকাতা/Law/বাবার চিঠি/ ২. হেমনলিনীঃমাতৃহীন/ ৩. কমলাঃ ৪. ডাক্তার নলিনাক্ষঃ * গঙ্গার প্রবল ঘুর্ণিঝড়...
-
১। উপন্যাসের আখ্যানভাগ কী ? ------- Plot বা কাহিনি-সমগ্র। ২। কাকতাড়ুয়া ’ উপন্যাসের মিঠুর ভাইয়ের নাম কী ? ------- মধু। ৩। বু...
-
পাঠ্যবইয়ে উল্লেখিত বিপরীত শব্দগুলোর একত্রে সন্নিবেশিত করে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পার..... প্রদত্ত শব্দ ------------...
-
ভূমিকা : ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যাঁর নামটি জড়িত, তিনি হলেন সৈয়দ মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর। জন্ম পরিচয় : তিতুমীর ভারতের পশ্চিমবঙ...
No comments:
Post a Comment