***জেনে নিন জমি বেদখল হলে আইন আপনার জন্য কী কী প্রতিকার রেখেছে ??
আজকাল যেখানে যায় সেখানে শুনি একজনের জমি আরেকজনে দখল করে নিয়েছে। আবার কেউ কেউ জাল দলিল তৈরি করে জমির মালিকানা দাবি করে কোর্টে মামলা ঠুকে দিচ্ছে। জমি-জমা নিয়ে কোর্টে প্রচুর পরিমান মামলাও হয়েছে এবং হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে এমন কোনো এলাকা বাকি নেই যেখানে প্রতিদিন জমিজমা নিয়ে বিরোধ হচ্ছে না। তাই জমি বেদখল হতে রক্ষা করার জন্য আইন আপনার জন্য দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় ধরণের প্রতিকার রেখেছে। এখানে কোনোটি দীর্ঘমেয়াদি আবার কোনোটি তাৎক্ষণিকভাবে আপনার জমি বেদখল হতে রক্ষা করবে। আপনি যদি এই বিষয় নিয়ে একটু সচেতন থাকেন, তাহলে আপনার জমি বেদখল হতে আপনাকে অনেক্ষানি সাহায্য করবে। সে জন্য আপনাকে জানতে হবে, জমির বেদখল ঠেকাতে আইন আপনার জন্য কী কী প্রতিকার রেখেছে।
সম্পত্তি বেদখল কি ?
সম্পত্তি বেদখল বলতে বোঝায় প্রকৃত মালিক বা দখলদারকে তার মালিকানা বা দখল থেকে জোর করে উচ্ছেদ করে অবৈধভাবে সেখানে অন্য ব্যক্তির স্বত্ব বা দখল প্রতিষ্ঠিত করা। জমিজমা ভোগদখলে রাখার আশা মানুষের চিরকালের। তাই জমির দখল নিয়ে সবসময়ই সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। অসাধু দাঙ্গাটে প্রকৃতির লোকেরা প্রায়ই লোকজনকে জোরপূর্বক জমি থেকে উচ্ছেদ করে কিংবা চাতুরির আশ্রয় নিয়ে অন্যকে জমি থেকে চলে যেতে বাধ্য করে।
কিভাবে প্রতিকার পাবেন?
জমি থেকে বেদখল হলে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য দুই রকমের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। প্রথমত স্থানীয়ভাবে সালিশের মাধ্যমে বিরোধের নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা যেতে পারে। যেসব অঞ্চলে সালিশি প্রথা বিজ্ঞজনদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় এবং যেখানকার অধিবাসীরা শান্তিপ্রিয় ও যুক্তিবোধসম্পন্ন, তারা এই উপায়ে এরকম বিরোধের নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করে থাকে। এতে মামলা-মোকদ্দমার মতো দীর্ঘ প্রক্রিয়া এড়ানো যায়। স্থানীয় বিজ্ঞজনরা সালিশে বসে ন্যায়ানুগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যদিয়ে জমির আসল মালিককে তার জমির দখল বুঝিয়ে দিতে পারেন। জমি থেকে বেদখল হলে প্রতিকার পাওয়ার আরেকটি উপায় আদালতে মামলা মোকদ্দমা চালানো।
***ফৌজদারি ও দেওয়ানি এই দুই প্রকার আইনেই জমি বেদখল হওয়ার বেশকিছু প্রতিকার পাওয়া যায়।
ফৌজদারি প্রতিকার
জমি দখলকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে পারেন। এ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে হবে প্রথম শ্রেণীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। আর এ মামলা করতে হবে বেদখল হয়ে গেলে কিংবা বেদখল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেওয়ার দুই মাসের মধ্যে। কোনো মামলা করলে ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিপক্ষের ওপর সমন জারি করবেন। পরবর্তী সময়ে উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনবেন এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ শেষে সম্পত্তির দখলদার কে তা নির্ধারণ করবেন। প্রয়োজনে সরেজমিনে তদন্তের আদেশ দিতে পারেন পুলিশকে। তাদের দেওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রকৃত দখলদার কে, সে বিষয়ে রায় দেবেন। তবে ১৪৫ ধারায় প্রতিকার চাইতে গেলে এখানে স্বত্ব বা মালিকানা দাবি করা যাবে না। এর মাধ্যমে শুধু প্রকৃত দখলদার নির্ণয় করার জন্য প্রতিকার চাওয়া যাবে।
১৪৪ ধারায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে উৎ?পাত বা আশঙ্কিত বিপদের ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ আদেশ জারির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এই ধারা অনুসারে, যেসব ক্ষেত্রে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমতাপ্রাপ্ত অন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মনে হয় যে, এই ধারার অধীনে অগ্রসর হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে এবং সমস্যার আশু নিবারণ বা দ্রুত প্রতিকার বাঞ্ছনীয়, সেসব ক্ষেত্রে যে কোনো ব্যক্তিকে ওই ম্যাজিস্ট্রেট কোনো নির্দিষ্ট কাজ করা থেকে বিরত থাকার অথবা কোনো নির্দিষ্ট সম্পত্তি তার দখলে কিংবা তার অধীনে নেয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন, যদি ওই ম্যাজিস্ট্রেট বিবেচনা করেন, তার নির্দেশের কারণে আইনসঙ্গতভাবে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তির প্রতি বাধা, বিরক্তি বা ক্ষতি অথবা বাধা, বিরক্তি বা ক্ষতির ঝুঁকি, অথবা মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তার প্রতি বিপদ অথবা জনশান্তির বিরক্তি, দাঙ্গা বা মারামারি নিরোধের সম্ভাবনা আছে কিংবা তার এই নির্দেশ তা নিরোধে সহায়তা করবে।
দখলদারকে পুনর্বহাল
যখন কোনো জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ রিপোর্ট বা অন্য কোনোভাবে সংবাদ পেয়ে এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, তার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে জমি, পানি বা এ দুটির সীমানা সম্পর্কে এমন একটি বিরোধ রয়েছে, যা শান্তিভঙ্গের কারণ হতে পারে, তখন তিনি তার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিরোধের পক্ষদের সশরীরে বা আইনজীবীর মাধ্যমে তার আদালতে হাজির হওয়ার এবং বিরোধের বিষয়বস্তুতে প্রকৃত দখল সম্পর্কে তাদের নিজ নিজ দাবি সম্পর্কে বিবৃতি পেশ করার নির্দেশ দিয়ে একটি লিখিত আদেশ দেবেন। উভয় পক্ষ নির্ধারিত তারিখে নিজ নিজ বিবৃতি পেশ করলে ম্যাজিস্ট্রেট সেগুলো পড়বেন, প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন এবং কোন পক্ষ জমির দখলে ছিল সেটি নির্ণয় করার চেষ্টা করবেন। পূর্ববর্তী দুই মাসের মধ্যে যদি কোনো পক্ষ জোরপূর্বক বেদখল হয়ে থাকেন, তাকে ওই সম্পত্তির দখলদার হিসেবে বিবেচনা করবেন ম্যাজিস্ট্রেট। একই সঙ্গে তাকে তার জমিতে পুনর্বহাল করার উদ্যোগ নেবেন। দেওয়ানি আইনের ডিক্রির মাধ্যমে আইনসঙ্গতভাবে উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত দখলে থাকা পক্ষ দখল বহাল রাখবে মর্মে ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ দেবেন। আইনগতভাবে উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত ওই দখলের প্রতি সব ব্যাঘাত ঘটানো নিষিদ্ধ করে ম্যাজিস্ট্রেট একটি আদেশ দেবেন।
দেওয়ানি আদালতে মামলা
জমি থেকে বেদখল হলে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের বেশ কয়েকটি ধারায় মামলা করা যায়।
৯ ধারার মামলা
১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারার অধীনে দেওয়ানি আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করে জমির দখল পুনরুদ্ধার করা যায়। যিনি ভূমি থেকে বেদখল হয়েছেন তাকে বেদখল হওয়ার তারিখ থেকে ৬ মাসের মধ্যে দখল পুনরুদ্বারের দাবিতে মামলা করতে হবে। ৬ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলে মামলা তামাদি দোষে বারিত হবে। এভাবে ৯ ধারায় মামলা করে আদালতের মাধ্যমে দখল পুনরুদ্ধার করা যায়। তবে ৯ ধারার মামলা দায়ের করলে 'জমির মূল স্বত্ব কার' সেই প্রশ্নের নিষ্পত্তি হবে না। এর জন্য একই আইনের ৪২ ধারায় প্রতিকার আছে। একটি জমিতে কোনো ব্যক্তির জমির স্বত্ব যদি অস্বীকার করে যদি তাকে উচ্ছেদ করা হয় তবে জমির দখলে থাকা ব্যক্তি এই ধারায় প্রতিকার চাইতে পারেন। ৯ ধারায় মামলার প্রতিকার শুধু দখলসংক্রান্ত। আদালতের মাধ্যমে দখল পুনরুদ্ধার করা যাবে বটে কিন্তু ভূমির মালিকানার প্রশ্নটি এই ধারার অধীনে বিচার্য হবে না। এমনকি বাদী যদি সম্পত্তিতে নিজের স্বত্ব (মালিকানা) প্রমাণে সমর্থ নাও হন কেবল বেদখল হওয়ার আগ পর্যন্ত দখলে থাকা প্রমাণ করতে পারেন তবেই তিনি তার পক্ষে ৯ ধারার অধীনে ডিক্রি পেতে পারেন এবং বিবদমান ভূমিতে পুনর্বহাল হতে পারেন। সরকার কর্তৃক বেদখল হলে এ ধারায় কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না।
৮ ধারায় মামলা
সম্পত্তিতে যার বৈধ মালিকানা স্বত্ব আছে তিনি কোনো কারণে বেদখল হলে পরবর্তী ১২ বছরের মধ্যে ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ধারা মতে দেওয়ানি আদালতে মামলা করে সম্পত্তির দখল পুনরুদ্ধার করতে পারেন। এ ধারায় মামলা করতে হলে সম্পত্তিতে বাদীর মালিকানা স্বত্ব থাকতে হবে।
৪২ ধারায় মামলা
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের এই ধারায় কোনো মর্যাদা বা অধিকার সম্পর্কে আদালতের ঘোষণা পাওয়া যেতে পারে। আইনানুগ পরিচয় কিংবা কোনো সম্পত্তির স্বত্বের অধিকারী কোনো ব্যক্তি এমন যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে পারে, যে ব্যক্তি পূর্বোক্ত ব্যক্তির মর্যাদা বা অধিকারের ব্যাপারে তার স্বত্ব অস্বীকার করেছে কিংবা অস্বীকার করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ধরুন আপনার জমিতে হঠাৎ করেই আপনার প্রতিবেশী অংশ দাবি করছে। এমন অবস্থায় আপনি ৪২ ধারায় আদালতের কাছ থেকে এই মর্মে ঘোষণা নিয়ে আসতে পারেন যে, আপনার দলিলে বর্ণিত জমিতে অন্য কারো অধিকার নেই।
যেখানে কেবল স্বত্বের ঘোষণা ছাড়াও আরো প্রতিকার দাবি করা যেত, কিন্তু বাদী তা করা থেকে বিরত থাকে, সেখানে আদালত শুধু ঘোষণা প্রদান করবে না। যেমন_ যেখানে আপনাকে জমি থেকে বেদখল করা হয়েছে, সেখানে শুধু ৪২ ধারায় ঘোষণার মামলা করলে চলবে না, তার আগে জমির দখল পুনরুদ্ধারে ৮ কিংবা ৯ ধারায় মামলা করা হয়েছে কি না, আদালত সেটি দেখবে।
কোথায় ও কীভাবে আইনের আশ্রয় নেবেন
জমিজমার মালিকানা নিয়ে প্রতিকারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এখতিয়ারাধীন আদালতে মামলা করতে হবে। মামলার মূল্যমান চার লাখ টাকার কম হলে সহকারী জজ আদালতে এবং চার লাখের বেশি হলে অসীম এখতিয়ার পর্যন্ত যুগ্ম জেলা জজ আদালতে প্রতিকার চাইতে হবে। মামলা দায়ের করতে হবে আইনজীবীর মাধ্যমে। মালিকানাসহ দখলের প্রতিকার চাইলে জমির মূল্য বাবদ অ্যাড-ভ্যালোরেম (মূল্যানুপাতে) কোর্ট ফি দিতে হবে। ৯ ধারা অনুযায়ী শুধু দখলের জন্য প্রতিকার চাইলে সম্পত্তির মূল্য অনুসারে যে কোর্ট ফি তার অর্ধেক, অর্থাৎ অ্যাড-ভ্যালোরেম কোর্ট ফির অর্ধেক পরিমাণ কোর্ট ফি দিতে হবে। জমির মালিকানাসহ দখল কিংবা শুধু দখল চেয়ে প্রতিকারের ক্ষেত্রে যদি বাদী মনে করেন, তাঁর জমিটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাহলে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাইতে পারেন পৃথক আবেদনের মাধ্যমে।
সংগৃহীত--বাংলাদেশ আইনগত অধিকার)
No comments:
Post a Comment