রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জন্মঃ১৮৬১(২৫ শে বৈশাখ ১২৬৮- ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮)
পিতাঃ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
মাতাঃ সারদা দেবী
জন্মক্রমঃ- চতুর্দশ সন্তান এবং অষ্টম পুত্র।
ছদ্মনামঃ ভানুসিংহ ঠাকুর
১ম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ কবিকাহিনী(১৮৭৮)
১ম লিখিত কবিতাঃ বনফুল ১৮৭৮ লেখা,প্রকাশ ১৮৮০.
১ম লেখা উপন্যাস হলোঃ- করুণা(১৮৭৭-৭৮),ভারতী পত্রিকায় প্রকাশ।
১ম প্রকাশিত উপন্যাসঃ- বৌঠাকুরাণীর হাট(১৮৮৩)
১ম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসঃ চোখের বালি।
১ম প্রকাশিত নাটকঃ- 'বাল্মিকী প্রতিভা'(১৮৮১)
রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা ১৩টি নাটকে অভিনয় করেন।
১ম ছোটগল্পঃ---১৬ বছর বয়সে লিখেছিলেন 'ভিখারিনী '।
কাহিনী কবিতাঃ- কথা ও কাহিনী। প্রথমে দুটি থাকলে পরে একটি হিসেবে সংকলিত হয়।
★ নজরুলকে উৎসর্গ করেন'বসন্ত' গীতি নাট্যটি।
পিতাঃ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
মাতাঃ সারদা দেবী
জন্মক্রমঃ- চতুর্দশ সন্তান এবং অষ্টম পুত্র।
ছদ্মনামঃ ভানুসিংহ ঠাকুর
১ম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ কবিকাহিনী(১৮৭৮)
১ম লিখিত কবিতাঃ বনফুল ১৮৭৮ লেখা,প্রকাশ ১৮৮০.
১ম লেখা উপন্যাস হলোঃ- করুণা(১৮৭৭-৭৮),ভারতী পত্রিকায় প্রকাশ।
১ম প্রকাশিত উপন্যাসঃ- বৌঠাকুরাণীর হাট(১৮৮৩)
১ম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসঃ চোখের বালি।
১ম প্রকাশিত নাটকঃ- 'বাল্মিকী প্রতিভা'(১৮৮১)
রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা ১৩টি নাটকে অভিনয় করেন।
১ম ছোটগল্পঃ---১৬ বছর বয়সে লিখেছিলেন 'ভিখারিনী '।
কাহিনী কবিতাঃ- কথা ও কাহিনী। প্রথমে দুটি থাকলে পরে একটি হিসেবে সংকলিত হয়।
★ নজরুলকে উৎসর্গ করেন'বসন্ত' গীতি নাট্যটি।
★ রবীন্দ্রনাথ প্রথম গ্রামীন ক্ষুদ্রঋণ ও গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করেন। (এ জন্য তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমেরিকার আরবানায় ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান কৃষি ও পশুপালন বিদ্যায় প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে)
উপন্যাস -১২ টি
কাব্যগ্রন্থ - ৫৬টি
নাটক - ২৯টি
কাব্যনাট্য - ১৯টি
ভ্রমণকাহিনী - ০৯ টি
সঙ্গীত - ২২৩২ টি
চিত্রাঙ্কন - ২০০০ প্রায়।
ছোটগল্প - ১১৯ টি
আত্মজীবনী - জীবনস্মৃতি লিখেছিলেন।
এটি একটি রুপক কবিতা।
আর রুপক কবিতা হলো - সাধারণ ভাবের আড়ালে প্রচ্ছন্ন রয়েছে গভীর জীবন দর্শন।
কৃষক ------ কবি/ শিল্পস্রষ্টা।
ছোটক্ষেত ------ পৃথিবী।
বাঁকাজল ------ প্রতিকুল সময়।
সোনার ধান ------ শ্রেষ্ঠকর্ম।
সোনার তরী ------ মহাকালের প্রতীক।
সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ -১৮৯৪
সোনার তরী (১ম কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উৎসর্গ করেন- কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনকে।
----------------------------------------
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে’ আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা(ধান রাখার পাত্র)
ধান কাটা হ’ল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা(ক্ষুরের মতো ধারালো যে প্রবাহ বা স্রোত)
খর-পরশা(ধারালো বরশা)।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোট ক্ষেত আমি একেলা,
চারিদিকে বাঁকা জল(প্রতিকূল সময়) করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাত বেলা।
এ পারেতে ছোট ক্ষেত আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে’ যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোন দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙ্গে দু’ধারে,
দেখে’ যেন মনে হয় চিনি উহারে!
ওগো তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে!
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে!
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে!
যত চাও তত লও তরণী পরে।
আর আছে?—আর নাই, দিয়েছি ভরে’।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে’
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে
এখন আমারে লহ করুণা করে’!
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! ছােট সে তরী
আমারি সােনার ধানে গিয়েছে ভরি’।
শ্রাবণ গগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি’,
যাহা ছিল নিয়ে গেল সােনার তরী।
ফাল্গুন, ১২৯৮।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘সোনার তরী’।
উপন্যাস -১২ টি
কাব্যগ্রন্থ - ৫৬টি
নাটক - ২৯টি
কাব্যনাট্য - ১৯টি
ভ্রমণকাহিনী - ০৯ টি
সঙ্গীত - ২২৩২ টি
চিত্রাঙ্কন - ২০০০ প্রায়।
ছোটগল্প - ১১৯ টি
আত্মজীবনী - জীবনস্মৃতি লিখেছিলেন।
এটি একটি রুপক কবিতা।
আর রুপক কবিতা হলো - সাধারণ ভাবের আড়ালে প্রচ্ছন্ন রয়েছে গভীর জীবন দর্শন।
কৃষক ------ কবি/ শিল্পস্রষ্টা।
ছোটক্ষেত ------ পৃথিবী।
বাঁকাজল ------ প্রতিকুল সময়।
সোনার ধান ------ শ্রেষ্ঠকর্ম।
সোনার তরী ------ মহাকালের প্রতীক।
সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ -১৮৯৪
সোনার তরী (১ম কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উৎসর্গ করেন- কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনকে।
----------------------------------------
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে’ আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা(ধান রাখার পাত্র)
ধান কাটা হ’ল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা(ক্ষুরের মতো ধারালো যে প্রবাহ বা স্রোত)
খর-পরশা(ধারালো বরশা)।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোট ক্ষেত আমি একেলা,
চারিদিকে বাঁকা জল(প্রতিকূল সময়) করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাত বেলা।
এ পারেতে ছোট ক্ষেত আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে’ যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোন দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙ্গে দু’ধারে,
দেখে’ যেন মনে হয় চিনি উহারে!
ওগো তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে!
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে!
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে!
যত চাও তত লও তরণী পরে।
আর আছে?—আর নাই, দিয়েছি ভরে’।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে’
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে
এখন আমারে লহ করুণা করে’!
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! ছােট সে তরী
আমারি সােনার ধানে গিয়েছে ভরি’।
শ্রাবণ গগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি’,
যাহা ছিল নিয়ে গেল সােনার তরী।
ফাল্গুন, ১২৯৮।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘সোনার তরী’।
এটি বহুল পঠিত ও আলোচিত কবিতার মধ্যে একটি। একটি গ্রামীণ দৃশ্যপটের নিটোল বর্ণনা এতে উপস্থাপিত হয়েছে। কবিতার দৃশ্যকল্প মানুষকে চিরচেনা প্রকৃতিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে এখানেই শেষ নয়। এমন দৃশ্যপটের অন্তরালেও গভীর অর্থ নিহিত রয়েছে। তাই ‘সোনার তরী’ কবিতার ব্যাখ্যা একেকজন একেকভাবে উপস্থাপন করেছেন। এ পর্যন্ত অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, কিন্তু কোনোটাকেই ফেলে দেওয়া যায় না। আবার এককভাবে কোনোটাকেই গ্রহণ করা যায় না।
কবিতার দৃশ্যকল্প এ রকম—আকাশে মেঘ গর্জন করছে। চারিদিকে বরষার পানি থৈথৈ করছে। সঙ্গে খরস্রোত বয়ে চলছে। জমির ধান কেটে একটি ছোট খেতে কৃষক একা বসে আছেন, পার হওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। ধান কাটতে কাটতে নদীর জল বেড়ে গেছে। খেতের চারিদিকে নদীর বাঁকা জল খেলা করছে।
ওদিকে ওপারের দিকে তাকিয়ে কৃষক দেখলেন এই সকালেই মেঘ ছেয়ে আছে। ওপারের গাছগুলো ঢাকা পড়েছে মেঘের আড়ালে। এমনকি তার গ্রাম পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কেউ একজন গান গেয়ে নৌকা বেয়ে এপারের দিকে আসছে। দেখে তাকে পরিচিত মনে হচ্ছে। কিন্তু সে তো কোনো দিকে না তাকিয়ে ভরা নৌকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। কৃষক তাকে গলা ছেড়ে ডাকে—‘ওগো, তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে,/ বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।’
কৃষকের ডাকে কেউ একজন নৌকা নিয়ে আসতে থাকে তীরের দিকে। জানতে চায়, কৃষক কোথায় যাবে? কৃষক বলেন, ‘যেয়ো যেথা যেতে চাও,/ যারে খুশি তারে দাও, /শুধু তুমি নিয়ে যাও/ ক্ষণিক হেসে/ আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।’
মাঝি এসে নৌকায় সাধ্যমতো ধান তোলে। এতক্ষণ কৃষক যে ধান নিয়ে নদীর তীরে পারাপারের অপেক্ষা করছিলেন তা সব নৌকায় তুললেন। কিন্তু কৃষককে নেওয়ার মতো জায়গা হলো না। কৃষক রয়ে গেলেন ধানখেতে শূন্য নদীর তীরে। তার যা কিছু অর্জন ছিল তা নিয়ে গেল সোনার তরী।
সোনার তরী কবিতার দৃশ্যকল্প একটি গল্পের মতো। সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণিত। পড়ামাত্রই যেকোনো পাঠকের আর বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কথা যতই সহজ-সরল হোক না কেন, কবিতার ভাবার্থ মোটেও সহজ ছিলে না। রবীন্দ্রনাথ তো নিজেই বলেছেন, ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’।
‘সোনার তরী’ কবিতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘‘মহাকাল প্রবাহিত হইয়া চলিয়া যাইতেছে, মানুষ তাহার কাছে নিজের সমস্ত কৃত-কর্ম কীর্তি সমর্পণ করিতেছে এবং মহাকাল সেই সমস্তই গ্রহণ করিয়া এক কাল হইতে অন্য কালে, এক দেশ হইতে অন্য দেশে বহন করিয়া লইয়া যাইতেছে, সেগুলিকে রক্ষা করিতেছে। কিন্তু যখন মানুষ মহাকালকে অনুরোধ করিল-যে ‘এখন আমারে লহ করুণা করে’ তখন মানুষ নিজেই দেখিল যে—
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! ছোট সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়াছে ভরি!’
মহাকাল মানুষের কর্মকীর্তি বহন করিয়া লইয়া যায়, রক্ষা করে; কিন্তু স্বয়ং কীর্তিমান্ মানুষকে সে রক্ষা করিতে চায় না। হোমার বাল্মীকি ব্যাস কালিদাস শেক্সপিয়ার নেপোলিয়ান আলেক্জাণ্ডার প্রতাপসিংহ প্রভৃতির কীর্তিকথা মহাকাল বহন করিয়া লইয়া চলিতেছে, কিন্তু সে সেই সব কীর্তিমান্দের রক্ষা করে নাই। যিনি প্রথম অগ্নি আবিষ্কার করিয়াছিলেন, বস্ত্রবয়নের তাঁত ইত্যাদি আবিষ্কার করিয়াছিলেন, তাঁহাদের নাম ইতিহাস রক্ষা করে নাই, কিন্তু তাঁহাদের কীর্তি মানব-সভ্যতার ইতিহাসে অমর হইয়া আছে।”
এখানে কবিতার উপমার সঙ্গে মানবজীবনের গভীর একটি মেলবন্ধন তৈরি করেছেন কবি। ধরা যাক, মানুষ সারা জীবন ধরে ফসল ফলাচ্ছে। তার জীবনের খেতটুকু একটা দ্বীপের মতো। চারিদিকেই অব্যক্তের দ্বারা সে বেষ্টিত। যখন কাল ঘনিয়ে আসছে, যখন চারিদিকের জল বেড়ে উঠছে, তখন আবার অব্যক্তের মধ্যে তার ওই চরটুকু তলিয়ে যাওয়ার সময় হলো—তার সমস্ত জীবনের কর্মের যা কিছু ফল, তা সে ওই সংসারের নৌকাতে বোঝাই করে দিতে পারে। সংসার-সমাজ-রাষ্ট্র-পৃথিবী সমস্তই নেয়। কিন্তু যখন মানুষ বলে, ‘এর সঙ্গে আমাকেও রাখো’; তখন সংসার বলে—‘তোমাকে নিয়ে আমার কী হবে? তোমার জীবনের ফসল যা-কিছু রাখার সমস্তই রাখব, কিন্তু তুমি তো রাখার যোগ্য নও!’
কবিতায় কবি মহাকালকেই সোনার তরী বলেছেন। মানুষের যাবতীয় কর্ম মহাকাল গ্রহণ করে। কিন্তু ক্রমেই কর্মের স্রষ্টাকে ভুলে যায়। সোনার তরীও তা-ই করেছে। ধানগুলো থরে বিথরে সাজিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ধানের কর্তাকে সে তুলে নিতে পারেনি। কারণ কৃষককে নেওয়ার মতো জায়গা সোনার তরীতে ছিল না।
এছাড়া এটা হতে পারে কবির ব্যক্তি জীবনেরও আক্ষেপ। কবি দীর্ঘকাল কাব্যসাধনা করেছেন। এবার মহাকালের সোনার তরীতে কবির কবিতা তুলে দেয়ার সময় এসেছে। কবি তাঁর সাধনার সোনার ফসল মহাকালের হাতে সপে দিয়ে শূন্য হাতে বললেন, ‘এখন আমারে লহ করুণা করে’। কালস্রোত কবির সোনার ধান-অর্ঘ্য-নৌকা বোঝাই করে নিয়ে গেল। কিন্তু কবির স্থান সে নৌকায় হল না। কারণ, কবির ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে সোনার তরীর মাঝি (মহাকাল) কবির সৃষ্টিকে গ্রহণ করলেন মাত্র। তিনি যেন কবিকে বলে গেলেন, ‘তোমার জীবনে যা তুমি সঞ্চয় করেছো, তা-ই তোমার জন্য যথেষ্ট নয়। তোমার জীবনে আরও অনেক বর্ষা-বসন্ত আসবে, এখনো বহুকাল এই শূন্য নদীর তীরে বসে তোমাকে সোনার ফসল ফলাতে হবে।’
অন্যদিকে কবিতার মধ্যে ভরা বর্ষার ছবি ও গতি সুস্পষ্ট হয়ে আছে। কবিতাটির রচনাকাল ফাল্গুন ১২৯৮ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ইংরেজি ১৮৯২ সাল। ভরা বসন্তে কবি ভরা বর্ষার কথা লিখেছেন। তাই সোনার তরী প্রসঙ্গে বলা যায় যে, কবিতাটি সেই জাতের কবিতা ‘যা মুক্তদ্বার অন্তরের সামগ্রী, বাইরের সমস্ত কিছুকে আপনার সঙ্গে মিলিয়ে নেয়’।
রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠির মাধ্যমে তার ‘সোনার তরী’র প্রসঙ্গে জানা যায়, সোনার তরী রচনাকালে তিনি ছিলেন পদ্মার মাঝে জমিদারি বোটে। অথৈ পানি-আকাশে কালো মেঘ, ওপারে গাছপালার ঘন ছায়ার মধ্যে গ্রামগুলো, বর্ষার পরিপূর্ণ পদ্মা খরস্রোতে বয়ে চলছে। মাঝে মাঝে পাক খেয়ে ছুটছে ফেনা। নদী অকালে কূল ছাপিয়ে চরের ধান দিনে দিনে ডুবিয়ে দিচ্ছে। কাঁচাধানে বোঝাই চাষীদের ডিঙি নৌকা হু-হু করে স্রোতের উপর দিয়ে ভেসে চলছে। ভরা-পদ্মার ঐ বাদল-দিনের ছবি ‘সোনার তরী’ কবিতার অন্তরে প্রচ্ছন্ন এবং তার ছন্দে প্রকাশিত।
তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ‘সোনার তরী’ কাব্যটি যখন রচিত হয়, তখন কবির বয়স ৩০-৩২ বছর। তাঁর আগেকার কাব্যগুলো থেকে ‘সোনার তরী’ যে ‘একটি বিশিষ্ট অবস্থায় উপনীত হয়েছে’—অ্যাকাডেমিক রবীন্দ্র গবেষকদের অনেকেই তা লক্ষ করেছেন। জগৎ ও জীবনের প্রতি গভীর ভালোবাসাই ‘সোনার তরী’ কাব্যের মূল সুর—এ সত্যও তাঁদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে।
সোনার তরী নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী’ প্রবন্ধে যতীন সরকার উল্লেখ করেছেন, ‘কবি জগৎকে শুধু গভীরভাবে ভালোই বাসেননি, এর সঙ্গে তিনি আক্ষরিক অর্থেই একাত্ম হয়ে পড়েছেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সোনার তরী রচনার সময় রবীন্দ্রনাথ জমিদারি তদারক করতে পদ্মাপারের জনপদে ঘুরেছেন, মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে মিশেছেন, নিসর্গ প্রকৃতি ও মানব-প্রকৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয়ে যুক্ত হয়েছেন এবং এসবেরই ফলে জগৎ ও জীবনের প্রতি এ রকম গভীর ভালোবাসার কবিতাগুলো তার হাত দিয়ে বেরিয়ে এসেছে।’
আবার অনেকেই মনে করেন, কাব্যগ্রন্থের নাম-কবিতা ‘সোনার তরী’ নিয়ে বাগ্মিতার ঝড় উঠেছিল যখন; তখন ভক্ত-সমালোচকরা কবিতাটির অর্থ উদ্ধারের জন্য স্বয়ং কবির কাছেই ধরনা দিয়েছেন। কবির দেওয়া ব্যাখ্যাকেই তারা মোটামুটি মেনে নিয়ে কবিতার রূপকার্থ বিশ্লেষণ করেছেন। তারা বলেছেন: ‘সোনার তরী হচ্ছে বিশ্বের চিরন্তন অখণ্ড ও আদর্শ সৌন্দর্যে্যর প্রতীক, এর মাঝি হলো সৌন্দর্যে্যর অধিষ্ঠাত্রী দেবী, আর নদী- কাল প্রবাহ, কৃষক- মানুষ, খেত- জীবনের ভোগবহুল কর্মক্ষেত্র, ধান-খণ্ড সৌন্দর্যের সঞ্চয়।’
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে বাংলা ১৩৫৩ সনে বা ১৯৪৬ সালে শারদীয় সংখ্যা ‘পরিচয়’ পত্রিকায় বিশিষ্ট মার্কসবাদী সাহিত্যতত্ত্ববিদ অধ্যাপক নীরেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন, ‘… রবীন্দ্রনাথের কবি-প্রতিভা তাঁহাকে তাঁহার সামাজিক কর্তব্য হইতে রেহাই দেয় নাই। বাংলাদেশের কৃষি জীবনের সমস্ত ব্যর্থতা তাঁহার অন্তরে পুঞ্জীতূত হইল। এ দৃশ্য তাঁহার অপরিচিত থাকার কথা নয়। রৌদ্রে-বৃষ্টিতে সারা বৎসর খাটিয়া চাষী ক্ষেতে সোনার ধান ফলায়, আর নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবসায়ীর নৌকা আসিয়া তাহার সমস্ত ফসল উজাড় করিয়া লইয়া যায়। পড়িয়া থাকে কেবল শস্যহীন রিক্ত ক্ষেত্র, চাষীর মন হাহাকার করিয়া উঠে; এতদিন যাহা লইয়া সে ভুলিয়াছিল সবই যে থরে বিথরে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে, এখন কি লইয়া তাহার দিন কাটিবে? যে তরীতে তাহার সোনার ধান সাজানো হইয়াছে সেথায় তো তাহার ঠাঁই নাই। মহাজন শ্রমফলকে চায়, শ্রমিককে তাহার কি প্রয়োজন? সে কৃপা করিয়াও চাষীকে লইতে রাজি নয়, ঠাঁইয়ের এই অপব্যয় তাহার সইবে কেন? কাজেই সোনার তরী চাষীর যাহা কিছু ছিল লইয়া চলিয়া যায়। চাষী ‘শূন্য নদীর তীরে’ পড়িয়া থাকে, আর ‘শ্রাবণ গগন ঘিরে’ ঘন মেঘ তাহারই সমবেদনায় ঘুরিতে ফিরিতে থাকে।’
তার অনেক পরে ১৯৬৯ সালের এপ্রিলে ‘মানব মন’ পত্রিকায় পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ডা. ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার সঙ্গে অধ্যাপক নীরেন্দ্রনাথ রায়ের বক্তব্যের সাযুজ্যই শুধু নেই, সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে তা অধিকতর যুক্তিগ্রাহ্য এবং বিজ্ঞানসম্মত রূপ প্রাপ্ত।
এভাবে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী রীতিতে বিশ্লেষণ করলেই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের প্রকৃত মর্ম উদঘাটিত হতে পারে। অথচ তার বদলে আমরা ভাববাদী বিচার-পদ্ধতির ঘোলা জলে হাবুডুবু খাচ্ছি। তবে একথা সত্য—‘রবীন্দ্রনাথ বাস্তববাদী হলেও বস্তুবাদী নন’। তাই অনেক সময়ই বাস্তবকে সঠিকভাবে অনুধাবন করেও বাস্তবাতিরিক্ত অতিলৌকিকতার ভাবনা দিয়ে তার কবিতাকে তিনি মুড়ে দেন।
কবিতার দৃশ্যকল্প এ রকম—আকাশে মেঘ গর্জন করছে। চারিদিকে বরষার পানি থৈথৈ করছে। সঙ্গে খরস্রোত বয়ে চলছে। জমির ধান কেটে একটি ছোট খেতে কৃষক একা বসে আছেন, পার হওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। ধান কাটতে কাটতে নদীর জল বেড়ে গেছে। খেতের চারিদিকে নদীর বাঁকা জল খেলা করছে।
ওদিকে ওপারের দিকে তাকিয়ে কৃষক দেখলেন এই সকালেই মেঘ ছেয়ে আছে। ওপারের গাছগুলো ঢাকা পড়েছে মেঘের আড়ালে। এমনকি তার গ্রাম পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কেউ একজন গান গেয়ে নৌকা বেয়ে এপারের দিকে আসছে। দেখে তাকে পরিচিত মনে হচ্ছে। কিন্তু সে তো কোনো দিকে না তাকিয়ে ভরা নৌকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। কৃষক তাকে গলা ছেড়ে ডাকে—‘ওগো, তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে,/ বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।’
কৃষকের ডাকে কেউ একজন নৌকা নিয়ে আসতে থাকে তীরের দিকে। জানতে চায়, কৃষক কোথায় যাবে? কৃষক বলেন, ‘যেয়ো যেথা যেতে চাও,/ যারে খুশি তারে দাও, /শুধু তুমি নিয়ে যাও/ ক্ষণিক হেসে/ আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।’
মাঝি এসে নৌকায় সাধ্যমতো ধান তোলে। এতক্ষণ কৃষক যে ধান নিয়ে নদীর তীরে পারাপারের অপেক্ষা করছিলেন তা সব নৌকায় তুললেন। কিন্তু কৃষককে নেওয়ার মতো জায়গা হলো না। কৃষক রয়ে গেলেন ধানখেতে শূন্য নদীর তীরে। তার যা কিছু অর্জন ছিল তা নিয়ে গেল সোনার তরী।
সোনার তরী কবিতার দৃশ্যকল্প একটি গল্পের মতো। সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণিত। পড়ামাত্রই যেকোনো পাঠকের আর বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কথা যতই সহজ-সরল হোক না কেন, কবিতার ভাবার্থ মোটেও সহজ ছিলে না। রবীন্দ্রনাথ তো নিজেই বলেছেন, ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’।
‘সোনার তরী’ কবিতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘‘মহাকাল প্রবাহিত হইয়া চলিয়া যাইতেছে, মানুষ তাহার কাছে নিজের সমস্ত কৃত-কর্ম কীর্তি সমর্পণ করিতেছে এবং মহাকাল সেই সমস্তই গ্রহণ করিয়া এক কাল হইতে অন্য কালে, এক দেশ হইতে অন্য দেশে বহন করিয়া লইয়া যাইতেছে, সেগুলিকে রক্ষা করিতেছে। কিন্তু যখন মানুষ মহাকালকে অনুরোধ করিল-যে ‘এখন আমারে লহ করুণা করে’ তখন মানুষ নিজেই দেখিল যে—
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! ছোট সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়াছে ভরি!’
মহাকাল মানুষের কর্মকীর্তি বহন করিয়া লইয়া যায়, রক্ষা করে; কিন্তু স্বয়ং কীর্তিমান্ মানুষকে সে রক্ষা করিতে চায় না। হোমার বাল্মীকি ব্যাস কালিদাস শেক্সপিয়ার নেপোলিয়ান আলেক্জাণ্ডার প্রতাপসিংহ প্রভৃতির কীর্তিকথা মহাকাল বহন করিয়া লইয়া চলিতেছে, কিন্তু সে সেই সব কীর্তিমান্দের রক্ষা করে নাই। যিনি প্রথম অগ্নি আবিষ্কার করিয়াছিলেন, বস্ত্রবয়নের তাঁত ইত্যাদি আবিষ্কার করিয়াছিলেন, তাঁহাদের নাম ইতিহাস রক্ষা করে নাই, কিন্তু তাঁহাদের কীর্তি মানব-সভ্যতার ইতিহাসে অমর হইয়া আছে।”
এখানে কবিতার উপমার সঙ্গে মানবজীবনের গভীর একটি মেলবন্ধন তৈরি করেছেন কবি। ধরা যাক, মানুষ সারা জীবন ধরে ফসল ফলাচ্ছে। তার জীবনের খেতটুকু একটা দ্বীপের মতো। চারিদিকেই অব্যক্তের দ্বারা সে বেষ্টিত। যখন কাল ঘনিয়ে আসছে, যখন চারিদিকের জল বেড়ে উঠছে, তখন আবার অব্যক্তের মধ্যে তার ওই চরটুকু তলিয়ে যাওয়ার সময় হলো—তার সমস্ত জীবনের কর্মের যা কিছু ফল, তা সে ওই সংসারের নৌকাতে বোঝাই করে দিতে পারে। সংসার-সমাজ-রাষ্ট্র-পৃথিবী সমস্তই নেয়। কিন্তু যখন মানুষ বলে, ‘এর সঙ্গে আমাকেও রাখো’; তখন সংসার বলে—‘তোমাকে নিয়ে আমার কী হবে? তোমার জীবনের ফসল যা-কিছু রাখার সমস্তই রাখব, কিন্তু তুমি তো রাখার যোগ্য নও!’
কবিতায় কবি মহাকালকেই সোনার তরী বলেছেন। মানুষের যাবতীয় কর্ম মহাকাল গ্রহণ করে। কিন্তু ক্রমেই কর্মের স্রষ্টাকে ভুলে যায়। সোনার তরীও তা-ই করেছে। ধানগুলো থরে বিথরে সাজিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ধানের কর্তাকে সে তুলে নিতে পারেনি। কারণ কৃষককে নেওয়ার মতো জায়গা সোনার তরীতে ছিল না।
এছাড়া এটা হতে পারে কবির ব্যক্তি জীবনেরও আক্ষেপ। কবি দীর্ঘকাল কাব্যসাধনা করেছেন। এবার মহাকালের সোনার তরীতে কবির কবিতা তুলে দেয়ার সময় এসেছে। কবি তাঁর সাধনার সোনার ফসল মহাকালের হাতে সপে দিয়ে শূন্য হাতে বললেন, ‘এখন আমারে লহ করুণা করে’। কালস্রোত কবির সোনার ধান-অর্ঘ্য-নৌকা বোঝাই করে নিয়ে গেল। কিন্তু কবির স্থান সে নৌকায় হল না। কারণ, কবির ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে সোনার তরীর মাঝি (মহাকাল) কবির সৃষ্টিকে গ্রহণ করলেন মাত্র। তিনি যেন কবিকে বলে গেলেন, ‘তোমার জীবনে যা তুমি সঞ্চয় করেছো, তা-ই তোমার জন্য যথেষ্ট নয়। তোমার জীবনে আরও অনেক বর্ষা-বসন্ত আসবে, এখনো বহুকাল এই শূন্য নদীর তীরে বসে তোমাকে সোনার ফসল ফলাতে হবে।’
অন্যদিকে কবিতার মধ্যে ভরা বর্ষার ছবি ও গতি সুস্পষ্ট হয়ে আছে। কবিতাটির রচনাকাল ফাল্গুন ১২৯৮ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ইংরেজি ১৮৯২ সাল। ভরা বসন্তে কবি ভরা বর্ষার কথা লিখেছেন। তাই সোনার তরী প্রসঙ্গে বলা যায় যে, কবিতাটি সেই জাতের কবিতা ‘যা মুক্তদ্বার অন্তরের সামগ্রী, বাইরের সমস্ত কিছুকে আপনার সঙ্গে মিলিয়ে নেয়’।
রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠির মাধ্যমে তার ‘সোনার তরী’র প্রসঙ্গে জানা যায়, সোনার তরী রচনাকালে তিনি ছিলেন পদ্মার মাঝে জমিদারি বোটে। অথৈ পানি-আকাশে কালো মেঘ, ওপারে গাছপালার ঘন ছায়ার মধ্যে গ্রামগুলো, বর্ষার পরিপূর্ণ পদ্মা খরস্রোতে বয়ে চলছে। মাঝে মাঝে পাক খেয়ে ছুটছে ফেনা। নদী অকালে কূল ছাপিয়ে চরের ধান দিনে দিনে ডুবিয়ে দিচ্ছে। কাঁচাধানে বোঝাই চাষীদের ডিঙি নৌকা হু-হু করে স্রোতের উপর দিয়ে ভেসে চলছে। ভরা-পদ্মার ঐ বাদল-দিনের ছবি ‘সোনার তরী’ কবিতার অন্তরে প্রচ্ছন্ন এবং তার ছন্দে প্রকাশিত।
তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ‘সোনার তরী’ কাব্যটি যখন রচিত হয়, তখন কবির বয়স ৩০-৩২ বছর। তাঁর আগেকার কাব্যগুলো থেকে ‘সোনার তরী’ যে ‘একটি বিশিষ্ট অবস্থায় উপনীত হয়েছে’—অ্যাকাডেমিক রবীন্দ্র গবেষকদের অনেকেই তা লক্ষ করেছেন। জগৎ ও জীবনের প্রতি গভীর ভালোবাসাই ‘সোনার তরী’ কাব্যের মূল সুর—এ সত্যও তাঁদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে।
সোনার তরী নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী’ প্রবন্ধে যতীন সরকার উল্লেখ করেছেন, ‘কবি জগৎকে শুধু গভীরভাবে ভালোই বাসেননি, এর সঙ্গে তিনি আক্ষরিক অর্থেই একাত্ম হয়ে পড়েছেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সোনার তরী রচনার সময় রবীন্দ্রনাথ জমিদারি তদারক করতে পদ্মাপারের জনপদে ঘুরেছেন, মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে মিশেছেন, নিসর্গ প্রকৃতি ও মানব-প্রকৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয়ে যুক্ত হয়েছেন এবং এসবেরই ফলে জগৎ ও জীবনের প্রতি এ রকম গভীর ভালোবাসার কবিতাগুলো তার হাত দিয়ে বেরিয়ে এসেছে।’
আবার অনেকেই মনে করেন, কাব্যগ্রন্থের নাম-কবিতা ‘সোনার তরী’ নিয়ে বাগ্মিতার ঝড় উঠেছিল যখন; তখন ভক্ত-সমালোচকরা কবিতাটির অর্থ উদ্ধারের জন্য স্বয়ং কবির কাছেই ধরনা দিয়েছেন। কবির দেওয়া ব্যাখ্যাকেই তারা মোটামুটি মেনে নিয়ে কবিতার রূপকার্থ বিশ্লেষণ করেছেন। তারা বলেছেন: ‘সোনার তরী হচ্ছে বিশ্বের চিরন্তন অখণ্ড ও আদর্শ সৌন্দর্যে্যর প্রতীক, এর মাঝি হলো সৌন্দর্যে্যর অধিষ্ঠাত্রী দেবী, আর নদী- কাল প্রবাহ, কৃষক- মানুষ, খেত- জীবনের ভোগবহুল কর্মক্ষেত্র, ধান-খণ্ড সৌন্দর্যের সঞ্চয়।’
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে বাংলা ১৩৫৩ সনে বা ১৯৪৬ সালে শারদীয় সংখ্যা ‘পরিচয়’ পত্রিকায় বিশিষ্ট মার্কসবাদী সাহিত্যতত্ত্ববিদ অধ্যাপক নীরেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন, ‘… রবীন্দ্রনাথের কবি-প্রতিভা তাঁহাকে তাঁহার সামাজিক কর্তব্য হইতে রেহাই দেয় নাই। বাংলাদেশের কৃষি জীবনের সমস্ত ব্যর্থতা তাঁহার অন্তরে পুঞ্জীতূত হইল। এ দৃশ্য তাঁহার অপরিচিত থাকার কথা নয়। রৌদ্রে-বৃষ্টিতে সারা বৎসর খাটিয়া চাষী ক্ষেতে সোনার ধান ফলায়, আর নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবসায়ীর নৌকা আসিয়া তাহার সমস্ত ফসল উজাড় করিয়া লইয়া যায়। পড়িয়া থাকে কেবল শস্যহীন রিক্ত ক্ষেত্র, চাষীর মন হাহাকার করিয়া উঠে; এতদিন যাহা লইয়া সে ভুলিয়াছিল সবই যে থরে বিথরে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে, এখন কি লইয়া তাহার দিন কাটিবে? যে তরীতে তাহার সোনার ধান সাজানো হইয়াছে সেথায় তো তাহার ঠাঁই নাই। মহাজন শ্রমফলকে চায়, শ্রমিককে তাহার কি প্রয়োজন? সে কৃপা করিয়াও চাষীকে লইতে রাজি নয়, ঠাঁইয়ের এই অপব্যয় তাহার সইবে কেন? কাজেই সোনার তরী চাষীর যাহা কিছু ছিল লইয়া চলিয়া যায়। চাষী ‘শূন্য নদীর তীরে’ পড়িয়া থাকে, আর ‘শ্রাবণ গগন ঘিরে’ ঘন মেঘ তাহারই সমবেদনায় ঘুরিতে ফিরিতে থাকে।’
তার অনেক পরে ১৯৬৯ সালের এপ্রিলে ‘মানব মন’ পত্রিকায় পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ডা. ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার সঙ্গে অধ্যাপক নীরেন্দ্রনাথ রায়ের বক্তব্যের সাযুজ্যই শুধু নেই, সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে তা অধিকতর যুক্তিগ্রাহ্য এবং বিজ্ঞানসম্মত রূপ প্রাপ্ত।
এভাবে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী রীতিতে বিশ্লেষণ করলেই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের প্রকৃত মর্ম উদঘাটিত হতে পারে। অথচ তার বদলে আমরা ভাববাদী বিচার-পদ্ধতির ঘোলা জলে হাবুডুবু খাচ্ছি। তবে একথা সত্য—‘রবীন্দ্রনাথ বাস্তববাদী হলেও বস্তুবাদী নন’। তাই অনেক সময়ই বাস্তবকে সঠিকভাবে অনুধাবন করেও বাস্তবাতিরিক্ত অতিলৌকিকতার ভাবনা দিয়ে তার কবিতাকে তিনি মুড়ে দেন।
No comments:
Post a Comment