Ad-1

Thursday, June 23, 2022

জীবনানন্দ দাশ

সকলেই যার যার অবস্থানকে আলাদা করে চিহ্নিত করে যাবার চেষ্টা করেছেন।সকলে না হলেও অনেকে সফল হয়েছেন।এক্ষেত্রে সবার আগে যার নামটি আগে উঠে আসে তিনি আর কেউ নন - কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি এলেন,দেখলেন এবং জয় করলেন।জীবনানন্দ দাশ শুধু এলেন,দেখলেন ,জয় করলেন - এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রইলেন না।অন্যকেও দেখালেন কিভাবে জয়ী হতে হয়।রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত দেখালেন গদ্য কবিতার পথ।প্রভাব বিস্তার করলেন রবীন্দ্র চৈতন্যে।বাংলা সাহিত্যে এ এক অভাবনীয় ঘটনা।রবীন্দ্রনাথ সর্বাংশে আধুনিক মানুষ।তিনি জীবনানন্দকে মেনে তো নিলেনই,মনেও নিলেন অবলীলায়।

বুদ্ধদেব বসু জীবনান্দকে বলেছিলেন 'প্রকৃত কবি এবং প্রকৃতির কবি'। 
জীবনানন্দের জগৎ প্রায় সম্পূর্নরুপে চোখে দেখার জগৎ।তাঁর কাব্য বর্ণনাবহুল,তাঁর বর্ণনা চিত্রবহুল,এবং তাঁর চিত্র বর্ণবহুল - এটুকু বললেই জীবনানন্দের কবিতার জাত চিনিয়ে দেয়া সম্ভব হতে পারে।বর্ণনাকে পাঠকের মনে পৌছিয়ে দেওয়ার বাহন তাঁর উপমা।উপমার এমন ছড়াছড়ি আজকাল কোনো কবিতেই দেখা যায় না।তাঁর উপমা উজ্জ্বল, জটিল ও দূরগন্ধবহ।এক-একটি উপমাই এক-একটি ছোটো কবিতা হতে পারে।তিনি যে জাতের কবি তাতে উপমাবিলাসী না হয়ে তাঁর উপায় নেই,অর্থাৎ উপমা তাঁর কাব্যের কারুকার্য মাত্র নয়,উপমাতেই তাঁর কাব্য। মনে পড়ে বহুকাল পূর্বে জীবনানন্দ একবার কোন এক পত্রিকায় লিখেছিলেন, 'উপমাই কবিত্ব' 

জীবনানন্দবাবুর কাব্যরসের যথার্থ উপলব্ধি একটু সময়সাপেক্ষ ; তাঁর কবিতা একটু ধীরে-সুস্থে পড়তে হয়,আস্তে-আস্তে বুঝতে হয়।জীবনানন্দ বাবুর যে সুরটি আগাগোড়া বেজেছে, তাকে ইংরেজ সমালোচকের ভাষায় ''renascence of wonder ' বলা যায়। তাঁর ছন্দ,শব্দযোজনা ও উপমা ইত্যাদিকে চট করে ভালো কি মন্দ বলা যায় না- তবে 'অদ্ভুত' স্বচ্ছন্দে বলা যায়।

এ কথা ঠিক যে তিনি (জীবনানন্দ)  পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত আগাগোড়া রোমান্টিক। এক হিসেবে তাঁকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের antithesis বলা যেতে পারে।

'শিকার' কবিতায় বত্রিশটি পংক্তির মধ্যে পাওয়া যাবে চৌদ্দটি উপমা 'মতো' শব্দের তেরো বার ব্যবহার,'হাওয়ার রাত'-'মতো' সংখ্যা আট।


জীবননান্দ দাশের বনলতা সেন(১৯৪২) কাব্যগ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা ৩০টি।তার মধ্য থেকে ভালো লাগা কবিতার লাইনগুলো নিম্নরুপ :
১. চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রেরপর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‌‌‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।...........[বনলতা সেন]

২. আমি যদি হতাম বনহংস;
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে;

আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে
আকাশের রূপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-
তোমার পাখনার আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-
নীল আকাশে খই ক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,।।......[আমি যদি হতাম]

৩.কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়
পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;
....
আমারো ইচ্ছে করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো
গেলাসে-গেলাসে পান করি,........[ঘাস]

৪. হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো ? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!................[হায় চিল]

৫. "কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল , তোমারে চাই :"
***চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো- দুধে আর্দ্র – কবেকার শঙ্খিনীমালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।।।.............[শঙ্খমালা]

৬. "যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনাদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে".....
ভারতসমুদ্রের তীরে
কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে
অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে
আজ নেই ,কোনো এক নগরী ছিল একদিন,
কোন এক প্রাসাদ ছিল 
মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ....(নগ্ন নির্জন হাত)  

৭.প্রদীপ নিভায়ে র’বো বিছানায় শুয়ে;
অন্ধকারে ঠেস দিয়ে জেগে র’বো।
বাদুড়ের আঁকাবাঁকা আকাশের মতো।
স্থবিরতা, কবে তুমি আসিবে বলো তো।
 ....( স্বপ্নের ধ্বনিরা)

No comments:

Post a Comment

Recent Post

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯

১. ‘ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ’ কবিতায় সালামের হাতে কেন অবিনাশী বর্ণমালা ঝরে ? ক. সংগ্রামী চেতনার কারণে     খ. দুঃখিনী মাতার অশ্রুজল দেখে গ. বরকত...

Most Popular Post