দিরিলিস আর্তগ্রুল একটি অনবদ্য সিরিজের নাম।এ সিরিজে ৫ টি সিজনে ভাগ করে প্রায় ১৫০ টি ভলিউম বা সিরিজ আছে অর্থাৎ ৫ টি অধ্যায়ে ১৫০ টি পরিচ্ছেদ থাকার মতো। এ সিরিজ গুলোর মধ্যে কেউ একটি দেখা শুরু করলে আরেকটি দেখার চরম তৃষ্ণা জাগবেই।একটি সিরিজ দেখার পর দর্শকের নিজের কাছে মনে হবে যে,তিনি যেন মরুভূমির ঠিক মাঝখানে চলে এসেছেন এবং নিজেকে খুবই তৃষ্ণার্ত বলে মনে হবে।মরুভূমিতে তৃষ্ণার্ত পথিক যেমন পানির জন্য উৎগ্রীব ও উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে তেমনি একটি ভলিউম শেষ করে আরেকটি দেখার জন্য উদগ্রীব ও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়বে।
এ সিরিজে যেমন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা হয়,তেমনি কোন চরিত্রের মৃত্যু হতে পারে এই ভাবনাও হৃদয়ে ভয় জাগিয়ে তুলে।যেমনঃ
সাধু,দেশ প্রেমিক ও বিশ্বাসঘাতক আমির সাদেত্তিন কোপেকের মৃত্যু কখন হবে দর্শক যেমন শুধু এ প্রতীক্ষার যেমন প্রহর গুনতে থাকে,তেমনি ভয়ংকর ভিলেন বাইজো নয়ান মৃত্যুর জন্যও দর্শক উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
অপরদিকে আর্তগ্রুলের সহযোগী তুরগুত,বামসীসহ অন্যান্যদের একটু চুট লাগলে বা একটু বিপদে পড়লে দর্শকের হৃদয় প্রকম্পিত হয় তাদের কোন বড় ক্ষতি হবে বা মৃত্যু হবে এই ভেবে।
তিতুশের চেয়ে জঘন্য ছিল কুর্তুগলো।
বাইজু নয়ানের চেয়ে জঘন্য ছিল আমির সাদ উদ্দিন।
যাঙ্গোচ এর চেয়ে ভয়ংকর ছিল বাইবোলাত বে বা আলবাস্তি।
আমির সাদ উদ্দিন এমন একটি চরিত্র যে চরিত্রের মৃত্যু কখন হবে দর্শক শুধু সে অপেক্ষায় থাকে।অন্যদিকে কিছু চরিত্র এমন আছে মনের অজান্তে ঐ চরিত্রের এতটাই ভালোবাসা জন্মে যে,তাদের মৃত্যু মেনে নেওয়া তো যায় না,সে সঙ্গে তারা একটু আঘাত পেলেই মনে হবে দর্শক নিজেই আঘাত পেয়েছে।পরবর্তী এপিসোডে হয়তো ঐ চরিত্রের মৃত্যু হতে পারে ভেবে দুশ্চিন্তায় মন বিমর্ষ হয়ে যায়।তাদের মৃত্যু যেন কোন অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না।তাদের মধ্যে অন্যতম তুরগুত আল্প,বামসি,হালিমা সুলতানা,আসলিহান হাতুন,হাইমে হাতুন প্রমুখ ব্যক্তিগণ।তাদের প্রতি একটু আঘাত দর্শকের হৃদয়কে আহত করে।
যতই সিরিজ এগুচ্ছে আর্তগ্রুলের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার থলে ততটাই বড় হচ্ছে এবং পূর্বের চেয়ে শক্তিশালী ও সার্বিক দিক দিয়ে পরিপূর্ণ ,নৃশংস ভয়ংকর শত্রুর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করতে হয়েছে।
এ যেন বড় বড় শত্রুরা একজন বড় নায়ক ও বিশ্ব নেতাকে পরিণত করে তৈরি করছে।
সিরিজগুলো দেখে মনে হবে পৃথিবীর তাবৎ ফিল্ম সব বানানো, বানোয়াট ও দর্শকের মন ভোলানো ও দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।কিন্তু এ সিরিজগলো যেন করা হয়েছে দর্শকের মন ভোলানো ও মনোরঞ্জনই উদ্দেশ্য নয়,বরং প্রকৃতি ও ভাগ্যের নিজস্ব গতিতে ঘটে যাওয়া ঘটনার অনবদ্য ও অতিরঞ্জিতহীন স্বাভাবিক বিবরণ।
হালিমাসুলতানা,এরেস,আসলিহান,আইকিজ,দুমরুল,আলিয়ার বে,হাসাতোরিয়ান উস্তা,দোগান,শামসা,দিলিদিমির,ইসহাক,ওমর এ চরিত্রগুলো দর্শকের হৃদয়ে এতটাই ভালোবাসা সৃষ্টি করেছে যে,তাদের চলে যাওয়াটা দর্শকের হৃদয়কে বেদনায় বিধুর করে তুলেছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো আর্তগ্রুলের সঙ্গীদের মধ্যে যারা শহিদ হয়েছে,তাদের শহিদ হওয়ার পিছনে আর্তগ্রুলের এতটুকু দোষ ছিল বলে কেউ মনের মধ্যেও কল্পনা করতে পারবে না।প্রতিটি চরিত্র ও মানুষকে বাঁচানোর আর্তগ্রুল শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন।যেমনঃ তুরগুতকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে।
বামসিকে আর্তগ্রুলের বন্দীকে ছাড়িয়ে নিয়ে অপরাধ করলেও নিজের ভাইয়ের মতো মুহূর্তে সব অপরাধ ভুলে গিয়ে তাঁকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এসেছিল।
অনেক অনেক ভালোলাগা কিছু ঘটনা ও সংলাপ থেকে একটি ভালো ও বেদনা বিধুর সংলাপ হলো নিম্নরুপঃ
বামসি নিজের ছেলে আইবার্সকে উদ্ধার করে যখন বসতিতে ফিরে আসলে হাফসা তার ছেলে আইবার্সকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলছিল,"তোমার জন্য আমি আমার জীবন কোরবান করে দিতে পারি।" তখন উসমানের মনটা কেন জানি খারাপ হয়ে উঠেছিল।প্রথমে তা বুঝতে পারিনি।পরক্ষণে যখন দেখি সে তার মা হালিমার আঁচল নিয়ে লুকিয়ে বলতে থাকে "মা,যার কথা আমি শুনেই গেলাম,যাকে আমি কখনো দেখিনি",তোমার আদর কখনো পাইনি,জানি না তুমি যদি বেঁচে থাকতে তোমার আদর কী রকম হতো।উসমানের এই নীরবে লুকিয়ে কান্না দেখে ফেলে সেলচান হাতুন।পরক্ষণে
তাঁর চাচী সেলচান হাতুনের জিজ্ঞাসু মনের উত্তরে উসমানকে বলতে শুনি....
"সবারই মা আছে,তারা তাদের সন্তানদের বাহুডোরে আশ্রয় দেয়,তাদের দুঃখ ভাগাভাগি করে,কিন্তু আমার কেউ নেই,যখন কেউ মা বলে ডাকে আমার হৃদয়ে ব্যাথা অনুভব হয়,চোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে,ভেতর থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই।আমার মাও কি হাফসা হাতুনের মতো আত্মোৎসর্গী ও মমতাময়ী ছিলেন?"
"যখন কেউ মা বলে ডাকে,আমার হৃদয় বিষাদের আগুনে দগ্ধ হয়ে যায়,আর এই দগ্ধ হৃদয়কে শান্ত করা আমার জন্য বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়,এই বিষাদ আমার হৃদয়কে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয় আমাকে দগ্ধ করে।এই দগ্ধ হৃদয়কে নদীর উত্তাল ঢেউও শান্ত করতে পারে না,কিন্তু আমি তা কাউকে বলতে পারি না।"
এই করুণ দৃশ্য দেখে কোন দর্শক চোখের পানি আটকে রাখতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।
দিরিলিস আর্তগ্রুল সিরিজের
ঘটনার বিন্যাস,কাহিনীর জটিলতা,গল্প সাজানোর ধরণ,চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা,দ্বিধাদ্বন্দ্ব,কাহিনীর প্লট,ভাষার শিল্প সৌন্দর্য ও মাঝে মাঝে রাজকীয় আভিজাত্যপূর্ণ ভাষার ব্যবহার এসব কিছুই দিরিলিস আর্তগ্রুল- কে এতটাই সৌন্দর্যপূর্ণ করে তুলেছে যে,কোথাও কোন দাগ পড়ে নি।একেবারে নিখুঁত শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে।
এত ভালো সিরিজ তো বিশ্ববিজয়ী ও কালজয়ী সিরিজে পরিণত তো হবেই।
সাহিত্য সমালোচকঃ
জহির উদ্দীন
বি.এ(অনার্স),এম.এ,এলএল.বি
শিক্ষক,বি এ এফ শাহীন কলেজ চট্টগ্রাম।
No comments:
Post a Comment